corner

 মহাযোগী

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী

“ ঈশ্বরই একমাত্র সদগুরু । আমার চরণ ধরিস না – আচরণ ধর ” শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী (১৭৩০ খ্রি.– ১৮৯০ খ্রি.)

শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

১৭৩০ খ্রি.– ১৮৯০ খ্রি

“ ঈশ্বরই একমাত্র সদগুরু । আমার চরণ ধরিস না – আচরণ ধর ” শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী (১৭৩০ খ্রি.– ১৮৯০ খ্রি.) ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ন রায় চৌধুরী কতৃক তোলা বাবার একমাত্র অরিজিন্যাল ছবি ।

image

উৎসর্গ


পিতৃদেব স্বর্গীয় মাধব দাশগুপ্ত

মাতৃদেবী স্বর্গীয়া মনোমোহিনী দাশগুপ্ত



image

“পরিত্রানায় সাধূনাং বিনিশায় চ দষ্কৃতাম্ ধর্মসংস্থাপনায় সম্ভবামি যুগে যুগে ।। ” - শ্রীশ্রীগীতা ৪/৮

শাশ্বত উপদেশ

কেন বৃথা চিন্তা করিতেছ ? কাহাকে ব্যর্থ ভয় পাইতেছ ? কে তোমাকে মারিতে পারে ? আত্মার জন্ম হয় না, মৃত্যু ও হয় না । যাহা হইয়াছে , তাহা ভালই হইয়াছে, যাহা হইতেছে, তাহা ভালই হইতেছে । যাহা হইবে , তাহাও ভালই হইবে । তুমি বিগত দিনের আনুশোচনা করিবে না । একমাত্র বর্তমানই সত্য । তোমার কি গিয়াছে , যে তুমি কাঁদিতেছ ? তুমি কি লইয়া আসিয়াছিলে ,যে তুমি হারাইয়াছ ? তুমি কি গরিয়াছ, যা বিনাশ হইয়া গিয়াছে ? তুমি কিছুই লইয়া আস নাই, যা লইয়াছ এইখান হইতেই লইয়াছ । যা দিয়াছ , এখানেই দিয়াছ । যা পাইয়াছ পরমসত্তা হইতেই পাইয়াছ । যা দিয়াছ , তাহাঁকেই দিয়াছ ।খালি হাতে আসিয়াছ , খালি হাতে যাইবে । যা আজ তোমার , কাল অন্য কাহারও ছিল , পরশু অন্য কাহারও হইবে । তুমি সেইতাকেই নিজের ভাবিয়া খুশি হইতেছ । এই সুখই তোমার দুঃক্ষের কারন । পরিবর্তনই সংসারের নিয়ম । যাহাকে তুমি মৃত্যু ভাবিতেছ , সেটাই জীবন । এককক্ষে তুমি কোটিপতি হইতেছ , পরক্ষনেই তুমি দরিদ্র হইয়া যাইতেছ । আমার-তোমার , ছোট-বড় , আপন-পর মন হইতেই মুছিয়া দাও , তাঁরপরে তুমি সবার ও সব তোমার । না এই শরীর তোমার , না তুমি এই শরীরের । এই শরীর অগ্নি, জল, বায়ু, পৃথিবী,আকাশ হইতে উতপত্তি-তাহাও বিলীন হইয়া যাবে । এইটাই সবছেয়ে উত্তম পথ । যে এই পথের পথিক, সে সব প্রকার চিন্তা ও শোক হইতে মুক্ত থাকে । যা কিছু তুমি করিতেছ সেটাই সৃষ্টিকর্তাকে অর্পন করিয়া যাও। ইহাকেই তুমি সর্ব -বন্ধন মুক্ত হইয়া অচিরে জীবন মুক্তির অপার আনন্দ অনুভব করিবে । [সংগ্রহ ও অনুলিখন : বি. কে. শীতল]

আবির্ভাব

আজ থেকে দু’শত পঁচাশি বছর আগে বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত চৌরাশি চাকলা মৌজার কচুয়া গ্রামে ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে বাবা লোকনাথ জন্মগ্রহন করেন । তার পিতা শ্রী রামকানাই ঘোষাল ভক্তিপরায়ন নিষ্ঠাবান সদ্ ব্রাহ্মণরুপে সমাজে সবার প্রিয় ছিলেন এবং তার মাতা শ্রীমতি কমলাদেবী ছিলেন পবিত্রতা এবং মমতার এক অপরূপ মাতৃমূর্তি ।

সন্ন্যাস-ত্যাগের আদর্শের মূর্ত প্রতীক , ভারতের সমাজে আজও সবোর্চ্চ সম্মান এবং শ্রদ্ধার আসন গ্রহন করে আছে । শাস্ত্র সম্মতিক্রমে আজও ভারতের মানুষ বিশ্বাস করে ভারতবর্ষের কোন একজন যদি গার্হস্থ্য জীবনে ভোগের পথে না গিয়ে ত্যাগ এবং তিতিক্ষার ঈশ্বর লোভের পথ গ্রহন করে , তাহলে ঈশ্বর কৃপায় সেই কুল উদ্ধার হয়ে যায় ।

শ্রী রামকানাই ঘোষাল সাধক ছিলেন । লোকচক্ষুর অন্তরালেই চলত তার ধ্যান এবং আন্তরিক অধ্যাত্ন সাধনার প্রয়াস । গার্হস্থ্য জীবনে বন্ধন, যোগের সাধনায় এবং উচ্চতর অবস্থা লাভের বিগ্নগুলো তিনি অন্তর দিয়ে অনুভব করতেন, তাই তার জীবনে ফুটে উঠল এক দুর্নিবার ইচ্ছা । একটি সন্তানের শুরু থেকেই তাদের জীবনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এবং অর্পণ করতে হবে পরম প্রভুর চরণে । যা নিজের জীবনে তিনি করতে পারেনি, সেই আশা পূর্ণ করতে হবে নিজের সন্তানের মাধ্যমে, সেই হবে তার জীবনের চরম সার্থকতা । মনের এই পবিত্র ইচ্ছাটিকে

তিনি জানান তাঁর পতিগতপ্রাণা সরল ধর্মপত্নিকে । এই কথাও বলেন – আমাদের কুল উদ্ধারের জন্য তোমাকেই এই পরম আত্মত্যাগের ব্রত গ্রহন করতে হবে ।

তোমাকেই গ্রহন করতে হবে সেই বিরাট সম্ভাবনাময় জীবন বীজকে । তাঁর আবির্ভাবের জন্য তোমাকেই হতে হবে প্রভুময়, প্রার্থনা করতে হবে আমাদের জ্ঞানগর্ভ কথাসকল উত্থাপন করতেন এবং যাহাদের আমার হৃদয় সেদিকে আকৃষ্ট হয় এমন চেষ্টা করতেন । আমি একদিকে গুরুজনদিগের সাথে ক্রীড়া করতে করতে বৃদ্ধদিগের ঘেঁটু পূজা সামাধা হতে না হতেই লাঠি দ্বারা ভেঙ্গে দিতাম । এভাবেই আমার শৈশবকাল অতিবাহিত হয় ।

এই গ্রামেই বাস করতেন এক সর্বশাস্ত্রপারঙ্গম গৃহী সন্ন্যাসী শ্রী ভগবান গাঙ্গলী মহাশয় । তৎকালীন ভারতবর্ষের পণ্ডিত সমাজে তাঁর স্থান ছিল সর্বোচ্চ ।

মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী

লোকনাথের ভাবী ত্যাগময় জীবনের কাণ্ডারীরূপে শ্রী ভগবান গাঙ্গুলীর অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞান এবং গুপ্তযোগীর ভাবই রামকানাইয়ের মনে নিয়ে আসে এক পরম প্রতিশ্রুতি । তাই স্বয়ং ভগবানরুপী গাঙ্গুলীর শরণাপন্ন হন ও লোকনাথের জন্মবৃত্তান্ত শোনেন এবং আধ্যাত্ন জীবনের গুরুভার গ্রহন করার জন্য বারংবার বিনয়পূর্ণ নিবেদন করেন । তাঁর ইচ্ছা ভগবান গাঙ্গুলীই লোকনাথের আচার্যরূপে পবিত্র উপনয়ন সংস্কার করেন । ভগবান গাঙ্গুলী গভীর মনোযোগ সহকারে লোকনাথের জন্মবৃত্তান্ত শোনেন, তার শাস্ত্রঅউজ্জল প্রখর ধী শক্তির মাধ্যমে অনুমান করা করতে সুবিধা হয় না-কি কারনে জননী কমলাদেবী প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃ্তীয় সন্তান লাভের সঙ্গে সঙ্গে মায়ার কঠিন বন্ধনে অভিভূত হয়ে স্বামীকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে যান, অথচ লোকনাথের আবির্ভাবের শুভলগ্নে মততাময়ী মায়ের অন্তর ভরে উঠে দিব্য অনুপ্রেরনায় ,স্বতঃস্ফুর্ত হয়েই তিনি কেন তুলে দেন তার প্রানের প্রান লোকনাথের জগজ্জননীর বিরাট স্নেহময়বক্ষে । লোকনাথের জন্মজন্মান্তরের অসাধারন তপশ্চর্যা ও ভগবৎ প্রেমের সংস্কার এবং ভবিষ্যতের সম্ভবনাময় মহাযোগীর ছবিটি তাঁর সাধনলব্ধ শুদ্ধ মানসপটে ধ্রবতারার মতো জ্যোতিষ্মান হয়ে ভেসে উঠে । সানন্দে তিনি স্বীকৃতি দান করেন , বলেন, “ রামকানাই, তুমি পরম ভাগ্যবান, তাই এমন সন্তানের পিতা হবার সৌভাগ্য তুমি লাভ করেছ, আমি যেনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, এই ঈশ্বর প্রেরিত সন্তান কেবল তোমার ক্ষুদ্র কুলকে উদ্ধার করার জন্যই জন্মগ্রহন করেনি, এরমধে লুকিয়ে আছে জগত উদ্ধার বীজ, কালে এই সন্তানই অগনিত পাপতাপক্লিষ্ট লোকের নাথ হয়ে জগৎ গুরুর আসন অধিকার করবে । ”

“ তুমি চিন্তা করো না, সময় হলেই আমি শুভলগ্নে লোকনাথের উপনয়ন সংস্কার সম্পন্ন করবো এবং ঐদিনই দণ্ডিসন্ন্যাসের বেশে গৃহস্থ আশ্রম ত্যাগ করে সে আমার সঙ্গে যাবে সেই পথে যে পথে মহাজন গেছেন এবং কৃতকৃতার্থ হয়েছেন আত্মাজতাআন লাভে । ”

ভগবান গাঙ্গুলীর কথাগুলো শুনেছিলেন রামকানাই কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতোন, তাঁর অন্তরের আকুতি প্রানের ঠাকুর যে এমন করে শুনবেন, এমন করে যে কৃপাধারায় স্নাত হবেন তিনি, তাঁর লোকনাথ, তাঁরই সন্তান যে আদিষ্ট পুরুষ একথা ভাবতেও তাঁর শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে, আশ্রু গদ্গদ কণ্ঠে তিনি তাঁর প্রানের সবটুকু কৃতজ্ঞতা এবং আনন্দ ভগবান গাঙ্গুলীর চরণে অর্পণ করে বলেন, “ আপনি কৃপা করে লোকনাথের গুরুভার গ্রহন করলেন, এইঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারবো না, তবে লকোকনাথ যেনো গুরুনিষ্ঠার জীবন্ত ।

উদাহরণ হয়ে আপনার এই ত্যাগের পরম আদর্শের সেবা করতে পারে , এই প্রার্থনা জানাই প্রভুর চরণে । ” পরম শান্তি এবং দিব্য আনন্দের ভাবে আজ রামাকানাইয়ের মন প্রান যেন ভরে ওঠে, প্রভুর অহেতুক করুণা এবং ভবিষ্যতের দিব্যসম্ভবনা সব মিলিয়ে আজ যেনো তিনি কৃ্তকৃ্তার্থ । মহানন্দে তিনি ফিরে পেলেন তাঁর গৃহে ।

পিতা রামকানাই বালক লোকনাথকে বাল্ল্যকাল থেকেই সংস্কৃত কিংবা অন্য কোনো প্রাথমিক শিক্ষা দেবার ইচ্ছা ইচ্ছা অন্তরে অনুভব করলেন না । লোকনাথও বাসসুলভ চপলতায় এবং সমবয়সী বালকদের সঙ্গে খেলাধুলা করেই সময় কাটান।

তারই মধ্যে চলতে থাকে বয়শকদের ভারতের সাধুসন্তানদের অলৌকিক লীলাকথা শ্রবন । এভাবে দশটা বছর কেটে যায় । লোকনাথ এগারো বছরে পদার্পণ করলেন । বৈদিক কর্মযজ্ঞে নিপুণ, প্রবীণ ভগবান গাঙ্গুলী এক অতি শুভলগ্ন স্থির করলেন উপনয়ন সংস্কারের জন্য । সেই সঙ্গে সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন, তাঁর সিদ্ধান্তে যে ঐ একই দিনে তিনিও তাঁর গৃহস্থ আশ্রম ত্যাগ করে লোকনাথকে সঙ্গে করে অরণ্যবাসী হবেন শাশ্বত সত্য লাভের জন্য ।

লোকনাথের সমবয়সী খেলার সাথী বেণীমাধবের উপনয়ন সংস্কার দিনও একই দিনে স্থির হয় । সেও দৃঢ়ভাবে জানায় তাঁর মনের সংকল্প, লোকনাথের সাথী হয়েও সেও সাধু হবে, দর্শন করবে ভগবানকে ।

বেণীমাধবের মাতাপিতা এবং পরিবারের উপর এই ঘোষণা যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই মনে হয় । বেণীমাধবের মা পরমস্নেহভরে সন্তানকে বুকে টেনে নেন, আদর করে বোঝান সাধু জীবনের কষ্ট এবং কৃচ্ছ্রের কথা । বলেন, - “ বেণী, তুই বালক, তই জানিস না, ও পথ কত কঠিন । অনিশ্চয়তায় ভতা কণ্টকময় পথে তোকে আমি কি করে ছেড়ে যাব বাছা ? লোকনাথের মা-বাবা জন্ম থেকেই তোকে উৎসর্গ করে রেখেছে ভগবানের সেবার জন্য । কিন্তু তোকে নিয়ে যে আমার কতো আশা, তই আমাদের প্রানে এতো আঘাত দিস না । সংসারে থেকে , মা-বাবার সেবা করে মুনিঋষি ভগবান দর্শন করেছেন, তইও সেই পথ বেছে নে, ঠিক তাঁর কৃপা পাবি । ”

জন্মান্তরের শুদ্ধ সংস্কারের বীজগুলো অ অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছে । বেণীমাধবের সাত্ত্বিক আধারে । তাই মাতার কাতর ক্রন্দন, পিতার যুক্তি , কিছুই তাঁর বালক মনের দৃঢ়-সংকল্পকে তলাতে সক্ষম হয়নি।

বেণীমাধবের যে লোকনাথের কেবল খেলার সাথী নয়, সে যে তাঁর আত্মার আত্মীয়, সারাজীবন বন্ধুর কৃচ্ছ্রময় সাধন পথের সহযাত্রী । এ যে ঐশীপরিকল্পনা, বিধির বিধান । কোনভাবেই তাই বেণীমাধবকে তার অটল সিদ্ধন্ত থেকে বিচ্যুৎ করা সম্ভব হয় নি ।

ভগবান গাঙ্গুলী সব কথা শোনেন । সারাজীবন তিনি শাস্ত্রের গহীন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কতো পথ অতিক্রম করেছেন, কতো জ্ঞানই তিনি ধারণ করেছেন তাঁর মনের আধারে; কিন্তু এই দুই বালকের ক্রিয়াকলাপ কেমন যেন আশ্চর্য লাগে তাঁর কাছে, মনে থেকে বারবার কে যেনো বলে, “ যে জ্ঞান তুমি বহু কষ্টে লাভ করেছো টা এবার এই দুই বালকের মধে জীবন্ত করে তোলো, জগতে আরও একবার দেখিয়ে দাও ব্রহ্মচর্য এবং একনিষ্ঠ সাধনা করে মানুশ দেবদুর্লভ ব্রহ্মচর্য লাভ করে সমগ্র জগতের মঙ্গল এবং হিতসাধন করতে পারে । ”

ভগবান গাঙ্গুলীবেণীমাধবেরও উপনয়ন সংস্কার করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন এবং লোকনাথের সঙ্গে বেণীমাধবকেও সঙ্গে নেবেন বলে বালক বেণীমাধবকেও প্রতিশ্রুতি দেন । আচার্য গুরুর মুখ থেকে প্রতিশ্রুতির বাক্য শুনে দুই বালকই ঐ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে ।

একাদশ বছর বয়স্ক দুই বালক সন্ন্যাসীকে নিয়ে বৃদ্ধ মহাপণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলীর গৃহ ত্যাগের অত্যাশ্চর্য খবর যেনো দাবানলের মতোই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে । বৈদিক আচারে অনুষ্ঠিত উপনয়ন সংস্কারের শুভ দিনটিতে তাই দলে দলে উৎসুক নরনারী এসে উপস্থিত হয় রামাকানাই গৃহ প্রাঙ্গণে ।

পরমনিষ্ঠা সহকারে বৈদিক আচারনিষ্ঠ ভগবান গাঙ্গুলী রচনা করেন উপনয়ন সংস্কারের অনুষ্ঠান । কোনো অনুষ্ঠানেই যেনো এতোটুকু ক্রুটি না হয় সেদিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি । কর্মযজ্ঞের সাফল্য এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে ।

মুণ্ডিত মস্তকে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীর গেরুয়া বসন পরিহিত ত্যাগদীপ্ত দুই বালক ব্রহ্মচারীর দিকে সমগ্র সমবেত জনতাত দৃষ্টি নিবদ্ধ । ভগবান গাঙ্গুলীর উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারিত বৈদিক মন্ত্রে আকাশ-বাতাশ মুখরিত হয়ে উঠে । সাক্ষাৎ গায়াত্রী মা কমলা যেনো জুঁই ফুলের মতোন নিষ্পাপ ব্রহ্মচারীর বালককে কোলে নিয়ে বশে আছেন-নির্বাক হয়ে সমবেত নরনারী দর্শন করেছেন এই অনুষ্ঠান, বৈদিক যুগের ঋষিদের যজ্ঞ এবং বেদের মন্ত্র উচ্চারন যে দিব্যপ্রভাবের কথা তারা শুনেছিলেন, আজ যেনো টা মূর্তিমান হয়ে সামনে উপস্থিত । এই দৃশ্য ভোলার নয় ।

জননী কমলা দেবী নির্নিমেষ নয়নে স্নেহ এবং মমতাভরা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়া আছেন লোকনাথের দিকে, আজই তাঁর প্রাণপ্রিয় লোকনাথ গৃহত্যাগী হবে, আর তিনি তাঁর সন্তানকে দেখতে পাবেন না । একথা চিন্তা করলেই তাঁর অন্তরের এক অব্যক্ত

ব্যথা অনুভব করেন, চোখ ফেটে তাঁর জল আসে, তবুও তিনি তাঁর মমতার অশ্রু সংবরন করেন, তিনিই তো অনুমতি দিয়েছেন সন্তানের এই ত্যাগের জীবনের জন্য। ভয় পান চোখের জল সন্তানের আনন্দের পথে বিগ্ন যেনো না হয় । তাই মাতৃহৃদয়েরর সবটুকু সংযম শক্তিতেই একত্রিত করে চোখের উদ্গত সংযত করেন এবং সেই সঙ্গে যিনি জগতের পালক, যিনি জন্মদাতা তাঁর কাছে আকুল প্রার্থনা জানান – ‘ মাগো আমার লোকনাথকে তুমি দেখো, অর যেনো কোনো কষ্ট না হয়, ওকে তুমি কোলে করে রেখো মা । ”

উপনয়ন সংস্কার সম্পন্ন করেন আচার্য গুরু ভগবান গাঙ্গুলী । এবার বিদায়ের পালা । রামকানাই সন্তান গর্বে আজ আত্নহারা, ভিক্ষার ঝুলি গ্রহন করে এবং গুরুর আদেশ গনিয়ে মাতা-পিতার কাছে এসে উপস্থিত হয়, বিদায়ের অনুমতি এবং আশীর্বাদ গ্রহন করার জন্য, যেনো লোকনাথ পরমসত্য উপলব্ধি করতে পারে । মাতা কমলা দেবীও তাঁর সন্তান, লোকনাথ এবং বেনীমাধবকে পরমস্নেহভরে আলিঙ্গন করেন । দুই সন্তানের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন মায়ের প্রানভরা স্নেহ এবং মমতা দিয়ে ।

বৃদ্ধ ভগবান গাঙ্গুলী দুই বালক ব্রহ্মচারীকে দুই হাতে ধরে এগিয়ে যান, গৃহ প্রাঙ্গনের অসংখ্য নরনারী ভগবানের কাছে এই তিন মহান-ত্যাগী সন্ন্যাসির জন্য কৃপা ভিক্ষা চান । নির্লপ্ত ভাবেই এগিয়ে যায় তিনজন, গ্রামের সুদূ্র প্রসারিত ধান খেতের মধ্য দিয়ে , কেউই চোখের জল সংযত করতে পারেনি । এই ঐতিহাসিক ঘটনা সমবেত জনতার স্মৃতিপটে গভীর রেখপাত করে ।

গুরু ভগবান গাঙ্গুলী তাঁর বালক সন্তানদের নিয়ে পথে চলতে চলতে প্রথমেই উপস্থিত হন শক্তির মহাপাঠ কালীঘাটে । পরমকৃচ্ছ্র এবং ত্যাগ তিতক্ষাময় জীবনের প্রারম্ভেই তাঁর ইছা মহাশক্তির চরনাশ্রয়ে কিছুদিন ব্রহ্মচারীদের রেখে মায়ের কৃপাপ্রসাদ লাভ করা ।

তৎকালীন কলকাতা এবং কালীঘাটের সম্বন্ধে বাবা ভক্তদের গল্প বলতেন কলকাতা ছিল তখন জঙ্গলময় । আর কালীঘাটে মায়ের মন্দির ছিল বড় বড় গাছ গাছালীতে পরিবেষ্টিত ঘন বনস্থলী মধ্যে । ইরেজরা তখন কালীঘাটের আশেপাশে সওদাগরি ব্যবসা করতো ।

কালীঘাট ছিল তখন ত্যাগী সাধুদের তপস্যার স্থল । জতাজুতধারী তপস্বীরা এই জঙ্গলাকীর্ণ তপোভূমিতে সাধনে থাকতেন নিমগ্ন । দুই বালক ব্রহ্মচারী শুরু করে তাদের বাল্য-লীলা । কখনও কারুর জটা ধরে তান মারে , কখনও পেছন থেকে কৌপোনের কাপড় ধরে টানাটানি করে, আর ধ্যানভঙ্গ হলেই হাসতে হাসতে ছুটে পালায় । সাধুরা প্রথমে কিছুই বলে না কিন্তু একদিন তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়, তারা গুরু ভগবান গাঙ্গুলী ম ভোলান জবাব দেন সাধুদের অভিযোগের বিরুদ্ধেী । বলেন, এই দুই বালক ব্রহ্মচারীতো আপনাদের আশ্রমের , আমি তো গৃহী, কেবল আপনাদের দুই আপনজনদের দুই আপনাদেরকে ঘর থেকে আপনাদের আশ্রয়ে পৌঁছানো কর্তব্যটুকু পালন করছি – এবার আপনারাই ওদের শিক্ষা দিন ।

সত্যিইতো অকাট্য যুক্তি, সঙ্গে বিনয়ের মিশ্রণ । সাধু – সন্ন্যাসীরা প্রসন্ন চিত্তে নিজেদের আসনে ফিরে যান ।

গুরু ভগবান গাঙ্গুলী দুই ব্রহ্মচারীকে নিজের কাছে ডাকেন , সস্নেহে প্রশ্ন করেন তোমরা যে এই সাধনপাঠের সাধু সন্ন্যাসীদের জটা এবং কৌপীন ধরে বিরক্ত করছো, কিন্তু তোমরাওতোএকদিন বড় হবে, তোমাদের মাথায় জটা, অঙ্গে থাকবে কেবল কৌপীন, তখন তোমাদের কেউ এভাবে বিরক্ত করে, সাধনে বিধ্ন ঘটায়, তাহলে তোমারা কি করবে ?

আশ্চর্য হয় বালক লোকনাথ, অঙ্গে তাদের তখনও উপনয়নে দিন পরিহিত সুন্দর বস্ত্র । মুণ্ডিত মস্তক । কেবল কৌপীন হবে অঙ্গের বসন , মাথায় হবে জতা-এই রহস্য বালক লোকনাথের বোধগম্য হয় না । সপ্রতিভ ভাবেই সে তাঁর কৃ্তকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, সেই সঙ্গে তাঁর সংসয়ের সমাধান চায় । ”

গুরু ভগবান তাদের বোঝান তোমরা যে ঘর সংসার ছেড়ে এসেছো, কেবল ওদের মতন কঠোর তপশ্চর্যা এবং ধ্যান-সাধনা করার জন্য , তাকি তোমারা বোঝো না জন্মন্তরের শুদ্ধ সংস্কার এবার বালক লোকনাথের অন্তর জগতকে আলোড়িত করে, নির্ভীক নিঃশঙ্কচিত্তে সে গুরুদের প্রশ্ন করে , “ তবে তাই যদি সত্যি হয় , আমরা যদি ত্যাগী সন্ন্যাসী হবার জন্য গৃহত্যাগী হয়েছি তবে আমরা ভিক্ষা না করে ঘরের পাঠানো অর্থে কেন দিন যাপন করছি । ” গুরু ভগবান এই ত্যাগদীপ্ত কথাগুলো শুনে অত্যন্ত খুশি হন ।


অমৃত কথা

“ এগিয়ে পড়ো – পাবে , আরও আগে যাও – পাবে ।আরও এগিয়ে যাও – পাবে । ” - শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ

হিমালয়ে কঠিন তপস্যা এবং পরমসিদ্ধি লাভ

পুণ্য ভারতভূমি পুণ্যতম দেবভূমি হিমালয়ের আকর্ষণ যুগে ঋষি মুনি যোগী ভক্তই অনুভব করে আসছেন, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভূষিতা হয়ে স্বয়ং প্রকৃতি মা যেনো সন্তানকে কোলে তুলে করে বসার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। হিমালয়ের ধ্যানমৌন বহিঃপ্রকৃতি সহজেই অন্তর্গতকে ভতিয়ে তোলে এক প্রশান্ত অনুভূতিতে যা সাধকের অন্তরের শাশ্বত সত্যকে দর্শন করার পথকে করে সুগম ।

নিম্নভূমিতে বহুকাল সাধন করে এই তিন মহাতাপস চললেন ধ্যানমৌন হিমালয়ের কন্যা পার্বতীর কোলে বসে মহাবিশ্বের ধ্যানে মগ্ন হবার জন্য । পথ চলতে চলতে এক কালী সিদ্ধাইযুক্ত সাধুর সংস্পর্শে আসে লোকনাথ, মনে তাঁর প্রশ্ন জাগে, শুনেছেন হিমালয়ের হিমাবৃত প্রদেশে নাকি অসহনীয় ঠাণ্ডার প্রভাব, তাই সহজ মনেই দুইটি প্রশ্ন করেন সাধু মহারাজকে – হিমালয়ের ঠাণ্ডা তিনি সহ্য করতে পারবে কি না ? আর এই জীবনেই তিনি দর্শন করতে পারবে কি না সেই পরমসত্যকে । দুটি প্রশ্নের উত্তরে সাধু মহারাজ বলেন, “ হ্যাঁ, তুমি এই জীবনেই হিমালয়ের সাধনকালেই পরমসত্য লাভ করবে । ” আনন্দে ভরে উঠে লোকনাথের মন ,মনে এক নতুন উদ্যম ও এক দৃঢ়তা নিয়ে তিনি পৌছান হিমাআলয়ের সাধন পীঠে ।

হিমালয়ের বরফাবৃত এলাকায় কোথায়, কিভাবে কি ধরনের সাধনা করে যে তিনি যোগের উচ্চতম শিখরে আরূঢ় হয়েছিলেন, তা তাঁর মুখ থেকে শিষ্য বা ভক্তগন খুবই অল্প শুনতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

তাঁর অপরিমেয় যোগ শক্তির পেছনে যে বহুবর্ষব্যাপী অলৌকিক যোগ সাধনায় ইতিহাস লুকিয়ে ছিল টা কখনও কখনও ব্যক্ত করতেন অন্তরঙ্গ শিষ্যভক্তদের কাছে, তাঁর মাধ্যমেই আমরা তাঁর অলৌকিক সাধন জীবনের কিছু দর্শন পাই । তিনি বলেছেন যে, তাঁর পরমজ্ঞান লাভ হয় গীতা প্রদর্শিত ‘কর্মযোগের ’ মাধ্যমে ।

এবং শরণাগত ও তারই অসামান্য সাত্ত্বিক মেধা নিয়ে তিনি জন্মগ্রহন করে লোকনাথের সাধনায় উর্বর মাতিতে বপন করেছিলেন গীতা, উপনিষদ এবং পাতঞ্জলি যোগদর্শনের উৎকৃষ্ট বীজগুলো যা লোকনাথ তাঁর অতুলনীয় গুরুভক্তি এবং ঐকান্তিক শ্রদ্ধাপূর্ন নিষ্ঠা নিয়ে অনুশীলন করে যোগের এক একটি ভূমি অতিক্রম করে যোগ সাধনার বিভিন্ন পথ দিয়ে এমন এক অবস্থা লাভ করেন যা এক কথায় পরমব্রহ্মপদ অতীত এক অদ্বিতীয় সত্তায় নিত্যযক্ত হয়ে পরমানন্দে দ্রষ্টাবৎ অবস্থান করেন ।

এই অবর্ণনীয় উপলব্ধির কথা কার কাছেই বা বলবেন, কে বা বুঝাবে ,তবুও শিষ্য নারিশাবাবাকে বড়ই ভালবাসতেন । তাই মাঝে মাঝে তাঁর কাছেই কখনও কখনও ব্যক্ত করতেন তাঁর অন্তর জগতের কথা, বলেছেন – “ ওরে, সে জগতের কথা বলা কওয়া যায় না । বলতে গেলেই কম পড়ে যায় । তোদের শাস্ত্রের একটা কথা শুনেছিলাম – ‘ মূকাস্বাদনবৎ ’ হ্যাঁ , সত্যিই তাই, বোবা কিভাবে বলবে মিষ্টির স্বাদ ”

“ এই যে তোর সঙ্গে ঐ বিষয়ে কথা বলছি তাতেই আর শরীর খেয়াল রাখা সম্ভব হছে না, ভাবতে গেলেই হয়ে যাই , তাঁর ফলে শরীর থেকে ‘অলগ ’ হয়ে যেতে হয় । সেই আনন্দ অনুভূতির কথা কখনই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । ”

“মনে হয় এই বিরাট বিশ্ব সৃষ্টির মধ্যে আমি ওতপ্রোত হয়ে রয়েছি, আমার মধ্যেই বিরাজ করছে সমগ্র সৃষ্টি, আর সমগ্র সৃষ্টির আদিতে, মধ্যে এবং অন্তে আমিই শাশ্বত হয়ে আছি । একথা বলা কওয়ার নয়, তাই তো সারাদিন গৃহস্থ মানুষের ছোট ছোট সুখ – দুঃখের মধ্যে সময় কাটিয়ে চলেছি । ”

“ ভাবিস না তোদের সাথে জখন ব্যবহারিক জগতের কথা নিয়ে মেতে থাকি তখন ঐ উপলব্ধির আনন্দ জগৎ থেকে আমি বিচ্যৎ না, সে অবস্থা যে একবার লাভ করেছে আর বিচ্যতি সম্ভব নয় । আলাদা করে আর কিছুই করা সম্ভব নয় । সবের মধ্যে একের স্বাদ । ”

“ তোদের মত খাই – দাই, মল-মত্র ত্যাগ করি, তাই তোরাও আমাকে তোদের মত একজন ভেবে নিস । আমাকে তোরা শরীর ভেবে ভেবেই সব মাটি করলি । আমি যে কে, তা কাকে বোঝাবো ! সবাই যে ছোট ছোট চাওয়া নিয়েই ভহুল রয়েছে আমার প্রকৃ্ত আমিকে । ”

বাবা লোকনাথের প্রতিটি বানির মধ্যে খুঁজে পাই শ্রী কৃষ্ণকে । সেই পূর্ণপুরুষ যেনো আবার কায়া গ্রহন করেছেন, আবার বলেছেন গীতার জ্ঞান । অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহে শ্বরম !!

অজ্ঞানান্ধ মূঢ়চিত্ত মানুষ সর্বভূত মহেশ্বর স্বরূপ আমার পরমভাব বোঝে না, আমাকে মানুশদেহকারী সাধারন জীব বলে অবজ্ঞা করে ।

বাবা লোকনাথও বলেছিলেন, “ ওরে তোরা আমাকে শরীর ভেবে ভেবেই সব মাটি করলি । ” হিমালয়ে থাকাকালীন যে কঠিনতম তপস্যা বাবা লোকনাথ করেছিলেন তা প্রায় সবটুকু অজানা হয়ে রয়ে গেছে, একে তো বাবা ছিলেন ঘোরতর প্রচারবিমুখ যোগী তা ছাড়া কার সঙ্গেই বা বলবেন তাঁর প্রানের কথা, অনুভূতির কথা, উচ্চতম উপলব্ধির কথা । যতটুকু তিনি তাঁর শিষ্যদের, ভক্তদের কাছে ব্যক্ত করেছেন, তাও বা কতটুকু বুঝি আমরা । ধরা ছোঁয়ার বাহিরের জগৎ থেকে নেমে এসে আমাদের মতন অজ্ঞানান্ধ জীবকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা কেবল তাঁর অহেতুকী করুণা ছাড়া আর কিছুই বলা বা বোঝা সম্ভব নয় ।

বাবা বলেছেন, “ প্রায় অর্ধ শতাব্দীর অধিক কাল হিমালয়ে সাধনকালে গুরুদেব আমাকে তাঁর শাস্ত্রলব্ধ জ্ঞানের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাগুলো অনুশীলন করিয়ে নিয়েছিলেন । তাঁর উপর সর্বতোভাবে সমর্পন করে আমিও তাঁর প্রদর্শিত জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম এবং অষ্টাঙ্গ যোগের সবকটি পথে চলে পূর্ণ যোগের কতো পথই অতিক্রম করেছি, কোথাও এতোটুকু সন্দেহ হলে, তিনি মাতার স্নেহ দিয়ে পরম সহজে এগিয়ে গেছি পরম লক্ষ্যের দিকে । কঠিনতম যোগ সাধনায় সবকটি সোপান কেবল তারই কৃপায় আমি পার হতে সক্ষম হয়েছি । সমাধির গভীর আত্নমগ্ন অবস্থায় কতোদিন কেটে গেছে । ”

“সমাধিস্থ অবস্থায় অবস্থানকালে কতো বরফ এই শরীরের উপর জমেছে আবার গলে জল হয়ে গেছে ,তা খেয়াল কয়ারা মতন মনের চেতনা তখন আমার কোথায় ? ”

“ সমাধির উচ্চতম শিখরে বহুদিন অবস্থান করার পর পৌছালাম সেই পরমতত্ত্বে । সেখানে আমি ও সমগ্র অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিতের মধ্যে নেই কোনো ভেদাভেদ । মিলে - মিশে একাকার । ” “ পরমপুরস্কার এবং ঐশীকৃপায় মনুষ্য শরীরের এই উপলব্ধির পরে আর কোনো উপলব্ধি সম্ভব নয় । ”

বাবা লোকনাথ যখন পৌঁছালেন পূর্ণযোগের পুণ্য ভূমিতে পূর্ণ ব্রহ্মসরূপ হয়ে জগৎ উদ্ধারের জন্য ব্যবহারিক চেতনার জগতে আবার অবতরন করার জন্য তখন তাঁর বয়স ৯০ বছর । গুরু ভগবানের বয়স তখন ১৫০ বছর । বাবা লোকনাথ তাঁর ৮০ বছরের কথিনতম তপস্যার ফলস্বরূপ লাভ করলেন পরমসিদ্ধি । কিন্তু মনে আজ তাঁর বড় দুঃখ । দেখছেন সেই অন্তভেদী দৃষ্টি দিয়ে নিজের গুরুকে তাঁর অঝোরে ঝরে পড়েছে অশ্রু তাঁর দুই গণ্ডু বেয়ে । এতদিন নিজের সাধনার নেশায় ভুলে ছিলেন বহির্জগৎ , গুরুদের যে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন শিষ্যের মুক্তির জন্য, নিজের মুক্তি , নিজের সাধনার কথা ভুলে একথা তাঁর মনে জীবনেও উদয় হয়নি । গুরুর অসিদ্ধ অবস্থা দেখে তাই আজ পরমানন্দে দিনেও গুরুর চরণ ধরে কেবল অশ্রু বিসর্জন করেছেন করুণার মূর্তবিগ্রহ ভগবান লোকনাথ ।

ভাবছেন , এও কি সম্ভব ? ৮০ বছর কেটে গেল তাঁর দুই নাবালক সন্তানকে নিয়ে তিনি পথে বেড়িয়েছিলেন, সম্পূর্ণ অনশ্চয়তায় ভরা সন্ন্যাস জীবনের কন্তকময় পথে । মনে পড়ে যায় নিম্নভুমিতে থাকাকালীন উপবাসব্রত পালনকালে কয়েক যুগ ধরে তিনি কত মমতা দিয়ে মায়ের মতন মমতা দিয়েছেন দুই শিষ্যের । নিজের জন্য তা তিনি কোনোদিনও ভাবেননি । গুরু অসিদ্ধ অবস্থা দেখে তাই আজ তাঁর ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙ্গে যায় ।

গুরুদেব শিষ্যের মনের ভাব বুঝতে পারেন । আজ তাঁর আনন্দের সীমা নেই । লোকনাথের ৯০ বছরের দীর্ঘ জটাজুটমণ্ডিত দেহটি পরম স্নেহভরে কোলের মধ্যে টেনে নেন । লোকনাথ যে তাঁর দৃষ্টিতে আজও সেই উপনয়ন সংস্কারের দিনের বালক ব্রহ্মচারী । কতো আশীর্বাদ করেন তিনি, সবটুকু ভাষায় প্রকাশ করার মতোন ক্ষমতাও যে আজ হারিয়েছেন । শিষ্যের সাফ্যল্যের মধ্যে ভবিষ্যতের বহু নর - নারী, আবাল – বৃ্দধনিতার মুক্তির সম্ভবনার দিনগুলো আজ তাঁর চোখের সামনে কায়া গ্রহন করে যেন প্রকাশ পাচ্ছে । তাই তিনি আজ আনন্দ বিহবল হয়ে নির্বাক আশীর্বাদ জানান ।

বাবা লোকনাথের এই পরমসিদ্ধি লাভের মধ্য দিয়ে আমারা পাই এক নতুন দিকদর্শন । গুরু অসিদ্ধ হলেও , যদি শিষ্যে গুরুর প্রতি একনিষ্ঠা ভক্তি এবং বিশ্বাস নিয়ে গুরু প্রদর্শিত মার্গের অনুশীলন করতে চেষ্টা করেন তাহলে গুরুর কৃপায়, পরমমেশ্বরের অনুগ্রহে শিষ্যে পরমসত্য উপলব্ধি করতে পারে । কেবল তাইই নয় , গুরুর সিদ্ধিতেও শিষ্যে তাঁর সাধন জীবনে পায় বহু সহায়তা এবং কৃপা , ঠিক তেমনি শিষ্যে অসিদ্ধ সাধক গুরুর জীবনে নেমে আসে সেই একের ই অনন্ত আশীর্বাদ , শিষ্যের অহংমুক্ত শুদ্ধ আধারটিকে কেন্দ্র করে ।

গুরুদেবের বন্ধন দশা দেখে অধৈর্য হয়ে পড়েন সিদ্ধ শিষ্যে লোকনাথ । বলেন , “ গুরুদেব তোমার কৃপায় তোমার প্রদর্শিত পথে চলে আমি কতো সহজে কঠিন মায়ার এই ভবসাগর পার হয়ে গেলাম , কিন্তু তোমাকে মাঝ দরিয়ার পড়ে থাকতে পারে দেখে আমার যে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে । কবে তুমি মুক্তি লাভ করবে ? ”
যেখানে মনের সংকল্প - বিকল্প , শুদ্ধ – অশুদ্ধ , ধর্ম – অধর্ম , পাপ – পুন্যের সব বৃত্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় , সে অবস্থায় নির্বিকল্প সমাধির অবস্থা ।

ভক্তিশাস্ত্রের ভাষায় সাযুয্যমুক্তি, যেখানে ভক্ত ভগবান এক । যারা কেবল নিজের মুক্তির জন্যই সাধনা করেন , যাঁদের মধ্যে দয়ার সংস্কারের অভাব, তারা আর ফিরে আসেন না । কিন্তু যাঁদের আধারে আছে দয়া, করুণা , প্রেম – তাঁদের সব সংস্কারেই বিলয় হয় ঐ ভূমিতে , কিন্তু করুণার সংস্কারটা থাকে জীবন্ত । ঐ করুণার ভাবটিকে আধার করেই পরমপ্রভুর লীলা করেন জগতের বুকে মানুষকে তাঁর স্বরূপের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য । কালের ক্ষুদ্র বৃত্তি সেখানে রূপান্তরিত হয় করুণার মন্দাকিনী ধারায় । মনুষ্য জীবনের মধ্যেই যে বিরাট দিব্য রূপান্তরিত বীজ লুকিয়ে আছে যুগে যুগে তিনিই টা প্রকাশ করেন তাঁর ভক্ত , যোগীর শুদ্ধ আধারকে অবলম্বন করে ।

লোকনাথের মধ্যে জগদ গুরুরুপটি গুরুর অন্তর্দৃষ্টিতে কোনোদিনই চাপা থাকেনি । লোকনাথ সিদ্ধি লাভ করলে যে তাঁর মধ্য থেকে করুণার শতধারা কিভাবে ছড়িয়ে পড়বে , দিক – দিগন্তরে , তা গুরু জানতেন বলেই তো এতো কষ্ট স্বীকার করেছেন, এই দিনটি দেখার জন্যই তো তাঁর জনাকীর্ণ শরীরটিকে তিনি টেনে নিয়ে চলেছিলেন, তাই পরম আনন্দে লোকনাথকে আশীর্বাদ করে বলেন গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী – “ লোকনাথ, তুই কাঁদিস না, তোর অসামান্য যোগসিদ্ধির আমার চোখ খুলে দিয়েছে । জ্ঞান এবং ভক্তির মিশ্রণে যে কর্মের পথ পরমপ্রভু গীতায় দেখিয়েছেন সেই পূর্ণযোগের সমন্বয় তোর মধ্যে হয়েছে । শুষ্ক জ্ঞানের পথ বড় কঠিন । তোর মধ্যে জ্ঞানের ভক্তির মনিকাঞ্চন যোগ ঘটাতে পেরেছিলেন, গুরুভক্তি এবং পরম শ্রদ্ধাকে আশ্রয় করে তাই তুই কৃতকৃতার্থ হয়েছিস । আমার জন্য চিন্তা করিস না । আমার শীঘ্রই কাশী যাব , সেখানে এই পুরাতন শরীর ত্যাগ করে নতুন নতুন শরীর নিয়ে তোরই কাছে ফিরে আসবো , তখন তুই আমাকে এই যোগসমন্বয়ের ধারাটি গুরুরূপেই ধরিয়ে দিস ।

আর যেন ভুল না হয় । দেখিস তোর মধ্যেই আমার মুক্তির দ্বার সহজে খুলে যাবে । গুরুদেব যে এমন কথা বলবেন ভাবতে পারেনি লোকনাথ । তিনি যে এমনভাবে গুরুদাবের সেবা করার সুযোগ এই শরীরেই পারবেন এই যেনো তাঁর স্বপ্নেরও বাহিরে । আজীবন তিনি গুরুদেবের সেবার সুযোগটি তাঁর কাছে আসতেই তিনি গুরুদেবের চরণ দুটি আরও নিবিড় করে ধরেন,বলেন, “আমি তোমার লোকনাথ, লোকনাথই থাকবো, তোমার মুক্তির পথ তুমিই কৃপা করে তোমার এই সন্তানের মাধ্যমে করে নাও । তোমার সেবা করতে পারলেই আমি চিরধন্য হব ।

জীবন্মুক্ত পুরুষ এবং শাস্ত্রজ্ঞান ব্রাহ্মন শাস্ত্রের বিধানকে কখনই অশ্রদ্ধা করেন না গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী জানেন যে শাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী একই শরীরের অসিদ্ধ গুরু কখনই সিদ্ধযোগী শিষ্যের কৃপা প্রার্থী হয়ে মুক্তির জন্য ভিক্ষা চাইতে পারেন না, তাতে ‘ গুরু ’ ভাব খর্ব হয় । শিষ্য লোকনাথও জানতেন যে , তিনি যদি ইচ্ছা করেন , তাহলে এক পলকেই তিন তাঁর গুরুদেবকে মুক্তি প্রদান করতে পারেন, কিন্তু দুই শাস্ত্রমূর্তি শাস্ত্রের বিধান সর্বোপরি আসন দিয়ে ঠিক করেন নতুন শরীর দিয়ে শিষ্যের কাছে ফিরে এসে গুরুদক্ষিণা গ্রহন করার ।

অমৃত কথা

“ নিজে যা অনুভব করতে পারিসনি , তা কাউকে বলিসনি । ”
- শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

“ জীবের চার প্রকার, - বদ্ধজীব, মুমুক্ষজীব, মুক্তজীব ও নিত্যজীব । নিত্যজীব – এঁরা সংসারে থাকেন জীবের মঙ্গলের জন্য, জীবদিগকে শিক্ষা দেবার জন্য । ”
- শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ

বাবা লোকনাথের ব্রহ্মচারীর বারদী আগমন

বহু ভক্তের আর্তি, বহু অনাথ সন্তানের প্রানের আকুল করা ‘ মা ’ ডাক যেনো এতোদিনের পৌছালো জীবন্মুক্ত মহাপুরুষ লোকনাথের হৃদয়ের গভীরে, এবার অবতরনের পালা । এবার তিনি লীলায় হবে মূর্ত । বহু পাহার পর্বত , বন – জঙ্গলে তিনি পরিভ্রমন করেছেন ,ভাবগত উপলব্ধির সকল ঐশ্বর্যই এখন তাঁর করতলগত, বিশ্বের পূর্ণ ভাণ্ডারের ভাণ্ডারী হয়ে এবার তাঁর আবির্ভাব হবে লীলার জগতে, অনাথের নাথ হয়ে, ত্রিলোকের নাথ হয়ে তিনি আবার লীলায় প্রকট ।

বেণীমাধবকে সঙ্গে নিয়ে চীনের মধ্য দিয়ে হিমালয়ের উচ্চ শিখরগুলো অবলীলায় পায়ে হেঁটে অতিক্রমকরে তিব্বতের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর – পূর্ব সীমার হিমালয়ের পাদদেশে দিয়ে নেমে এসেছেন নিম্নভূমিতে । পথে কিছুদিন অবস্থান করেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের অতি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে । এখান থেকেই যে ভগবান ভক্তের সঙ্গে তাঁর অলৌকিক লীলা আরম্ভ করবেন । সবতুকুই যে নির্ধারিত ।

এই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ পথে হেঁটে চলছেন দুই উলঙ্গ সন্ন্যাসী । হঠাৎ কোথা হতে কানে আসে এক বাঘের বন কাঁপানো বিকট গর্জন । এই গর্জন যেন প্রকৃতির পবিত্র নিস্তব্ধতাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে দেয় । মুহূর্তের জন্য মনটাকে একবার ঐ গর্জনের উৎসের দিকে ফেরান লোকনাথ । এই যেন টর্চের আলো, যেদিকে তুমি ফেরাবে সে স্থান হয়ে উঠবে আলোকিত, দেখতে পাবে সব বস্তু । বাবা লোকনাথ বোঝেন এই গর্জন এক সদ্য প্রসবা বাঘিনীর । গর্জনের অর্থও তাঁর কাছে অবিদিত নয়,

ধ্যান নয়নে সবই মুহূর্তেই দেখে নিয়েছেন, বুঝে নিয়েছেন । মমতায় ভরা মাতৃহৃদয় যে বাঘিনীর মধ্যে প্রকট, তাই বাঘিনীর চিন্তা সুন্দর শিশুগুলোকে কোথায় সে রেখে নিশ্চিত হয়ে আহারের সন্ধানে যাবে ? তাই এই অসহায় গর্জন ।

সম – দর্শনের মূর্ত বিগ্রহ বাবা লোকনাথের মনে জাগে এক গভীর অনুকম্পা । ত্বরিতগতিতে পৌঁছান বাঘিনীর কাছে, বাচ্চাগুলো কিংবা মা, কেউই ভীত হয় না দুই মহা পুরুষকে দেখে; যেনো পরিচিত জন এসেছেন । অহিংসায় প্রতিষ্ঠিত যোগী, তাই জন্তু ভুলে যায় তাঁর জান্তব প্রবৃত্তি । বাবা করুণা মাখানো দৃষ্টি প্রসারিত করেন বাঘিনীর উদ্দেশ্যে, বুঝিয়ে দেন- “ মা তুমি যাও তোমার সন্তানের জন্য আহারের সন্ধানে, ওদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমার, কোনো চিন্তা কোর না । আমি যাকে রক্ষা করি কার সাধ্য অনিষ্ঠ করে ? ”

হৃদয়ের এই মৌন ভাষা কিন্তু বাঘিনীর বুঝে নিতে মুহূর্ত বিলম্ব হয় না, সেক্ষনেই বাবার উপর বাচ্চাদের দায়িত্ব দিয়ে বাঘিনী রওনা দেয় আহারের সন্ধানে ।

এভাবে চলতে থাকে দিনের পর দিন বাবার অপরূপ লীলা । নেই কোনো অভিযোগ নেই কোনো প্রতিবাদ, রোজই বাবার কাছে সন্তানের রেখে দিয়ে বাঘিনী পরম নিশ্চিন্তে রওনা হয় বাচ্চাদের আহারের সন্ধানে গভীর জঙ্গলে । বাবাও পরমানন্দে ঐ ছোট ছোট বাঘের বাচ্চাগুলোকে নিজের খেলার সাথী করে নেন, তাঁদের সঙ্গে খেলা করে সময় কাটান ।

দেখতে দেখতে বাচ্চাগুলো বড় হয়ে উঠে , বাবা লোকনাথ ভাবেন এবার তাঁর দায়িত্ব শেষ, তাই বেনিমাধবকে নিয়ে একদিন রওনা হন সে স্থান ছেড়ে ।

কিন্তু কিছু পথ অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে শোনেন সেই বাঘিনীর গর্জন । বিনা অনুমতিতেই তো তিনি চলে যাচ্ছিলেন, ফিরে আসেন বাঘিনীর কাছে; বোঝেন বাঘিনীর মনের কথা, বাচ্চাগুলো এখনও তেমন বড় হয়নি যাঁদের সে জঙ্গলে নিয়ে যেতে পারে, তাই তাঁর মনোগত ইচ্ছা, তিনি আরও কিছুদিন ঐ স্থানে থেকে বাচ্চাগুলোকে আরও একটু বড় দেখে যান । তথাস্তু বলে সেখানেই থেকে যান লোকনাথ । আরও কিছুদিন পালন করতে হয় এই গুরুত্বপূর্ণ সেবার দায়িত্ব । অতঃপর যখন বাচ্চারা বড় হয়ে যায় , মায়ের সাথে মহানন্দে তারাও ছোটাছুটি করে আহারের সন্ধানে যেতে সক্ষম হয়, তখন বাবা বাঘিনীর অনুমতি পান । চোখের জলে অন্তরের কৃ্তজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বাঘিনী বাবাকে অনুমতি জানান ।

পথ চলতে চলতে বেনিমাধব জানায় তাঁর অন্তরের ইচ্ছা – একবার শক্তির মহাপাঠ কমাখ্যা দর্শন তাঁকে করতে হবে মা যেনো সন্তানকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন, তাঁর সারাজীবনের অপূর্ণভাবে পূর্ণনন্দময়ী মা যেনো পূর্ণ করার জন্য আকর্ষণ করেছেন তন্ত্রের সিদ্ধপীঠ কামাখ্যায় । লোকনাথ বোঝেন বাল্যাকালের প্রানপ্রিয় সখার সঙ্গে বিরহের মুহূর্তটি এবার উপস্থিত । প্রায় ১৪০ বছর যে তাঁরা একই সঙ্গে জীবনের কতো বন্ধুর পথ দিয়ে হাতে হাত ধরে এগিয়েছিলেন, কতো বিচিত্র অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছেন , কতো ভাবে একে অপরকে করেছেন সাহায্য । কিন্তু পূর্ণজ্ঞানেই নেই আসক্তি লেশ । তাই নির্লিপ্ত দুই যোগী একে অপরের কাছে বিদায় নেন ।

লোকনাথ বলেন – “ বেণী, তুই কামাখ্যায় যাচ্ছিস যা, আমি চললাম আমার কর্মভূমিতে, তবে তোর মনে যখন আমায় দেখতে ইচ্ছা জাগবে , তুই আমায় অন্তরেই অন্তরেই ডাকিস আমি সূক্ষ্ম শরীর নিয়ে মুহূর্তেই পৌঁছে যাবে তোর কাছে । ”

লোকনাথ একাই চলেছেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, হঠাৎ দেখেন জঙ্গলের মধ্যে চতুর্দিকে অগ্নিদেবের মহাতাণ্ডব । দাবানলের লেলিহান শিখা যেনো আকাশকে চুম্বন করার জন্য উর্ধ্বে উঠেছে, পশু -পক্ষী ভীত আর্ত হয়ে ছুটছে প্রানের তাগিদে । পশু – পখির আর্ত গর্জন এবন কলরবে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখেন লোকনাথ ।

প্রভুদেব শ্রিবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী এই সময়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের এক বৃক্ষের তলায় আসন করে ধ্যানে রয়েছেন নিমগ্ন । হঠাৎ গগনভেদী আর্তনাদ এবং কলরবে তাঁর ধ্যানের ধারায় ছেদ টেনে দেয়, চোখ খুলে দেখেন চতুর্দিকে অগ্নির লেলিহান শিখা যেনো এক প্রাচীরের আকার ধারক করী তাঁকে আত্নসাৎ করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে অগ্রসর হচ্ছে । এই সঙ্কটময় মুহূর্তে কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেও তাঁর মনে এতোটুকু ভয়ের উদয় হয় না , যাকে তিনি রক্ষা করার ভাবটির পরিচয় যে তিনি অনেক ভাবেই দর্শন করছেন, তাই একাগ্রচিত্ত হয়ে তিনি মধুসুদনকে স্মরন করেন – বিপদে যে তিনিই রক্ষা করেন ভক্তকে, তাঁর শরণাগতকে ।

‘ ন মে ভক্তঃ প্রনশ্যতি ’(৩১/৯ ভঃ গীঃ) – আমার ভক্তের বিনাশ নেই । হঠাৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী দেখেন এক অদ্ভুদ দৃশ্য । অগ্নির লেলিহান শিখার মধ্য দিয়ে এক জটাজুটমণ্ডিত দীর্ঘদেহী শিবকল্প দিগম্বর সন্ন্যাসী এগিয়ে আসছেন তারই দিকে দুটি অজানুলম্বিত হস্ত প্রসারিত করে । মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর ভারি শরীরটি অবলীলায় যোগী তুলে নেন নিজ্র কোলে, ছোট শিশুর মতন বসিয়ে নেন তাঁর স্কন্ধের উপর এবং যে পথে এসেছিলেন সে পথেই আবার রওনা হন । কিন্তু কি অলৌকিক এই লীলা, বিজয়কৃষ্ণজী দেখছেন অগ্নির মধ্য দিয়ে যোগী চলেছেন অগ্নির শিখাও তাঁর অঙ্গে লাগছে ; কিন্তু অগ্নির সেই তাপ নেই,

কেবল এক শীতল স্পর্শ যেন তিনি অনুভব করেন তাঁর সর্বাঙ্গে । তারপর আর তিনি কিছু মনে করতে পারেন না । যখন সম্বিৎ ফিরে পান তখন তখন দেক্ষেন পাহাড়ের এক অতি সুরক্ষিত স্থানে তিনি শয়ন করে আছেন । সমস্ত ঘটনাই যেন তাঁর কাছে এক অদ্ভুদ স্বপ্নদর্শন বলে মনে হয় । বোঝেন প্রভুই তাঁকে কৃপা করে সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করে রক্ষা করলেন নিশ্চত মৃত্যুর হাত থেকে । অন্তরের সবটুকু প্রেম তিনি ঢেলে দেন অপরিচিত ঐ সন্ন্যাসের রূপটি মানস কল্পনা করে তার চরণে ।

পরবর্তীতে বারদীর মহাতীর্থে যখন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী দর্শন করতে যান বাবাকে তার চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দাবানলের কথা স্মরন করিয়ে দেন এবং জিজ্ঞেস করেন কে তাকে ঐদিন রক্ষা করেছিলো – মুহূর্তেই মানসপটে ঐ ভয়াবহ দিন্তির কথা ভেসে উঠে এবং ভগবৎ প্রেরিত মহাপুরুষের যে রূপটি দেখতে পান সে যে তারই সামনে সশরীরের বসে আছেন তার বড় আপনজনটি সেজে । মৌন কৃতজ্ঞতায় বিজয়কৃষ্ণজীর অন্তর -জগৎ প্লাবিত হয়, বাবার চরণ দুটি ভক্তিভরে তিনি নিজের বক্ষের মধ্যে টেনে নেন, মস্তকে নেন পুণ্যস্পর্শ ।

বাবার অসাধারণ যোগবিভূতি এবং করুণার পরিচয় লাভ করে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী বাবার এক অনুগত ভক্তরূপে প্রকাশিত হন এবং তার অগনিত ভক্তের কাছে ঢাকা এবং বাংলাদেশের নানান স্থানে ধর্ম প্রচারের সময় বাবার অসামান্য যোগভক্তির কথা প্রচার করেন । তারই প্রচারের ফলে, কালে বহু দূরদুরান্ত হতে বহু নরনারী উপস্থিত হন বারদীর পুণ্যভূমিতে, ধন্য হন বাবার কৃপাপ্রসাদ লাভ করে । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী তার শিষ্যভক্তদের কাছে বলেন তার তীর্থ দর্শনের এক অভিজ্ঞতার কথা । একবার উত্তর ভারতের বহু তীর্থ দর্শন করে তিনি

উচ্চকোটির যোগী মহাপুরুষ দর্শন অ তার কৃপা লাভ করার জন্য হিমালয়ের দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করে পৌঁছান মানস সরোবরের উর্ধ্বে এক তুশারবৃত সাধন পাঠে । সে স্থান সাধারনের অগম্য । সেখানে পৌঁছে তিনি দর্শন করেন প্রাচীন শরীরধারী দীর্ঘ জটাজটমণ্ডিত কয়েকজন সমাধিস্থ যোগীপুরুষকে । প্রথম দর্শনেই বুঝতে অসুবিধা হয় না বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী যে বহু যুগ ধরে এই মহাপুরুষগণ এ স্থানে সমাধির উচ্চ অবস্থায় মগ্ন হয়ে আছেন । সাষ্টাঙ্গে প্রতিপাত করেন তিনি সকলের উদ্দেশ্যে , কৃপা পরবশ হয়ে তার সমাধির জগৎ থেকে নেমে আসেন ,স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন বিজয়কৃষ্ণজী প্রতি, বলেন , “ বেটা তুই এতো কষ্ট করে এতো দুর্গম পথে কেনো এখানে এসেছিস, তোর ঘরের পাশেই যে বিরাজ করছেন এক মহাপুরুষ যিনি আমাদের থেকেও অনেক উন্নত, উচ্চ অবস্থা লাভ করে তোদের জন্য নিম্নভুমিতে গেছেন । ”

বিজয়কৃষ্ণজী সেই সময় বাবা লোকনাথের বারদীতে অবস্থানের কথা জানতেন না, পরবর্তীকালে যখন বাবা লোকনাথ প্রথম দর্শন পান তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই প্রাচীন সন্ন্যাসীদের কোথাগুলো – “ আমাদের থেকেও অনেক উন্নত, উচ্চ অবস্থা ল্যাব করে তোদের জন্য তিনি নিম্নভূমিতে গেছেন । ” – ধন্য হন সাক্ষাৎ যোগেশ্বরের দর্শন লাভ করেন ।

বারদী নিবাসী ডেঙ্গু কর্মধারায় , এক ফৌজধারী মামলায় স্থানীয় বিচারকের বিচারাধীনে দাউদকান্দিতেই অবস্থান করেছেন । মোকদ্দমার অবস্থা শৌচনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে, তাই ডেঙ্গু নিজের প্রান এবং সম্মান বাঁচানোর তাগিদে তখন মরীয়া হয়েই ছুটে বেড়াচ্ছে এক উকিল থেকে ার এক উকিলের কাছে,অসহায় অবস্থা দেখে অনেকেই তার এই দুরবস্থার সুযোগ নিতেও ছাড়ে না । জীবনের এক পরম সঙ্কটজনক অবস্থার সে সম্মুখীন আজ ।

দুই – একদিনের মধ্যেই রায় বেরোবে, তাতে নিশ্চত সে দোষী প্রমান হবে, তারপর আর সে ভাবতে পারে না ।

উদভ্রান্ত হয়ে গ্রামের পথ ধরে চলেছে সে এমন সময় তার চখে পড়ে এক অসাধারণ মনুষ্যমূর্তি এক বৃক্ষের তলায় উপবিষ্ট তারই যেনো তাকিয়ে আছেন । গাত্রবর্ণ বরফের মতন সাদা, চোখ দুটি আকর্ণবিস্তৃত পলকহীন,দীর্ঘ জটাজটমণ্ডিত এই দেহ যেন এই পার্থিব জগতের নয় । ডেঙ্গু মুহূর্তের মধ্যে খুঁজে পায়, যাকে সে তার নিজের আজান্তে জন্মে জন্মে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতোন ঐ চোখ দুটি তাঁকে আকর্ষণ করে, মন থেকে কে যেনো বলে, “ তুই পেয়ে গেছিস, আর তোর কোন চিন্তা নেই, কেবল নিজেকে অর্পণ করে দে, আর তোর ভার তোকে বইতে হবে না, সব দায়িত্ব তাঁর । ”

ছুটে যায় সে সাধুর চরণাশ্রয়ে , চরণ দুটির মধ্যে মাথাটি রেখে অসহায় শিশুর মতোন ফুঁপিয়ে কেদে উঠে, বলে, “ তুমি আমাকে বাঁচাও, আর আমি মনের এই দুঃখ জ্বালা সহ্য করতে পারছি না । ”

শরণাগতকে রক্ষা করার জন্যইতো তাঁর আবির্ভাব ।
মধুর কণ্ঠে অভয়বাণী উচ্চারিত হয় “ তোর কোন চিন্তা নেই, আমি নিজের হাতে তোর রায় লিখে এসেছি, তোর বেকুসুর খালাস হবে । ” সহজ মানুষ, এমন কথা যে কেউ বলতে পারে এই তাঁর সব অভিজ্ঞতার বাইরে, কিন্তু এই মানুষটি কথার মধ্যে কি এক যাদু রয়েছে, যা অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত পৌঁছে যায়, সংশয়পূর্ণ মনের সব সংস্কারকে ছাপিয়ে জেন এক গভীর বিশ্বাসের তরঙ্গ মনের সব কুল ছাপিয়ে যেনো উছলে ওঠে । পরম শ্রদ্ধাভরে বার বার প্রনাম জানিয়ে ফিরে আসে ডেঙ্গু ।

পরের দিন্সে আদালতে পৌঁছায়, সবাই জানে ডেঙ্গুর অদৃষ্টের কি লিখন, কিন্তু বিচারক যখন রায় বলেন সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়- বেকসুর খালাস হয়েছে সে, এমন কি উচ্চ কোনো আদালতেও এই মামলার আর শুনানি সম্ভব নয় । এই অসম্ভবটি যার ইচ্ছায় সম্ভব হলো, মুহূর্তের মধ্যে সেই করুণা মাখানো স্থির দৃষ্টি যেন ডেঙ্গু আদালাতে বসেই মানস নয়নে দেখতে পায় । জগৎ ভুলে যায়, আনন্দেরবিহবলতারউন্মাদেরমতনছুটেচলেসেইপথেরমধ্যদিয়েসেইপরিচিতবৃক্ষের তলায়, দেখতে পায় তাঁর প্রানের মানুষটিকে, কিন্তু একি ভাবের পরিবর্তন । ফিরেও তাকান তিনি ডেঙ্গুর জীবনের সব থেকে আনন্দের মুহূর্তে, নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছেন দিগন্তের দিকে, যেনো এই জগতের একজন হয়েও কোনো সম্বন্ধেই নেই পার্থিব জগতের সঙ্গে ।

চোখের জলে চরণ দুইটি ধুইয়ে দেয় ভক্ত ডেঙ্গু, তাঁর অন্তরে কৃতজ্ঞতার ভাবটি প্রকাশ করার মতন কোনো ভাষায় সে খুঁজে পায় না, কেবল উদ্গত অশ্রু তার দৃষ্টিশক্তিকে বারবার ঝাপসা করে তোলে, কণ্ঠ হয় রুদ্ধ । মনের মধ্যে এক অনাবিল শান্তি এবং আনন্দের ছোঁয়া পায় সে মহাপুরুষের চরণতলে বসে, জগতের সব অশান্তির জ্বালা, স্বার্থকেন্দ্রিক সংকীর্ণতায় সব ক্ষুদ্র গণ্ডাই যেনো ভেঙ্গে যায়, সে যেনো তারই অজান্তে বয়ে চলেছে এক আনন্দের নির্ঝরণীর স্রোতে । এমন অনুভুতি তো সে তার সংসার জীবনে পায়নি । অল্প শিক্ষিত হলেও বেপারতা বুঝতে তার দেরী হয় না , এই সবই কেবল ঘটে চলেছে এই অদ্ভুদ মানুষের ইচ্ছায় । তাই বাকী জীবনের দিনগুলো কেবল তার সেবা করার ইচ্ছা অন্তরে প্রবল হয়ে ওঠে । মনে হয় এই মানুষটিকে সে বহুদিন ধরে চেনে, এর উপর তার সব অধিকার সে অনায়েসে খাটাতে পারে ।

ডেঙ্গু পিতার প্রতি সন্তানের জন্মগত অধিকারের ভাব অন্তরের অনুভব করে বলে, “বাবা, তোমাকে আমি ছেড়ে চলে যেতে পারবো না । তুমি আমার প্রান রক্ষা করেছো, এই ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারবো না, তবুও আমার অন্তরের প্রার্থনা, তুমি আমার সঙ্গে ছোট্ট কুটিরে চল, তোমার চরণধুলা দিয়ে তাকে পরমতীর্থ করে তোলো, আর আমি আমার জীবনের শেষ দিন্তি পর্যন্ত তোমার সেবা করে যেনো তোমার চরণ লাভ করতে পারি এই আশীর্বাদ কর, আর আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না । ”

বড় আন্তরিক ডেঙ্গুর এই আবেদন । ভাবগ্রাহী মধুসূদন ভক্তের ভাবতুকুর পবিত্রতা, অকপটতা দেখার জন্যইতো বসে আছেন। তিনি যে ভক্তের ভগবান । তাই বাবা যেনো অতিবাধ্য সন্তানের মতনই বলেন, “ ডেঙ্গু,তুই আমায় ডাকছিস, আমি তোর সাথে যেতে প্রস্তুত; কিন্তু এই নেংটা পাগলটাকে ঘরে তুললে, সমাজের লোক যে তোকে ছিঃ ছিঃ করবে, টা কি তুই সহ্য করতে পারবি? তুই ভেবে দেখ । ”

ডেঙ্গুর কাছে সব অপমান সব লাঞ্ছনার উর্ধ্বে এই পরম প্রেমিক বাবার সঙ্গ । তাই সে বলে, - “ বাবা, তুমি সঙ্গে থাকলে আমার কোনো কষ্টই আর হবে না, তুমি কেবল ‘না’ বলো না। ”

বাবা বলেন, - “ ডেঙ্গু, তোর ভক্তি দেখে আমি সত্যিই প্রসন্ন । আমি তোকে কথা দিলাম, তুই যতোদিন চাস আমি ততোদিন তোর গৃহে থাকবো । ”

কথাবিলম্ব না করে ছুটে যায় সে নদীতটে, নৌকা ঠিক করে ছুটে আসে বাবার কাছে; বাবাকে পরম ভক্তি করে এগিয়ে নিয়ে যায় ।

নির্ধারিত পুরুষ ডেঙ্গু কর্মকার; বারদীতে সেই বাবা লোকনাথ রূপ নরনারায়ণকে আনয়ন করবে, এই তার জন্মার্জিত অধিকার, তাইতো বাবাও অতি সহজে ধরা দিলেন, এই সহজ সরল গ্রাম্য মানুষটি সহজ ভক্তির বন্ধনে আনন্দে তার মনপ্রান ভরে আছে, স্বয়ং ভগবান আসছেন তার ঘরে যতোদিন সে চায়। ততোদিন বাঁধা থাকবে তিনি, আজ যেনো সে বামন হয়ে চাঁদ ধরেছে । তার ছোট বাগানে ঘেরা কুটিরের মধ্যে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করে দেয় বাবার থাকার জন্য । বাবাও ছোট্ট শিশুর মতোন সেখানে মহানন্দে থেকে যান । কয়েক দিন যায়, গোঁড়া সমাজের দৃষ্টিতে এই ন্যাংটা সাধুকে ঘরে এনে তোলার বেপারটা কারুর চোখেই ভাল ঠেকে না । হতে পারে, এই সাধুর কৃপায় সে প্রান ফিরে পেয়েছে, কিন্তু ঘরে মেয়েছেলে নিয়ে থাকা, এটা ডেঙ্গু ঠিক করছে না – মুখে মুখে চর্চা চলতে থাকে এই নবাগত পাগল সাধুকে নিয়ে । এমনকি ডেঙ্গুর পরিবারের লোকও যে ডেঙ্গুর সমালোচক হয়ে উঠবে, এই যে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি । ডেঙ্গু ভাবে মহাপুরুষ টাকে প্রথমেই সাবধান করেছিলেন । তবুও সে হার মানার পাত্র নয় । এতো সমালোচনার, এতো অপমানসূচক কথা, বাবা কিন্তু আচল অটল, নির্বিকারভাবে তিনি দিন কাটান । কিন্তু ডেঙ্গু এই সমালোচনা এবং বাবার বিরুদ্ধে লোকের বিরূপ মনোভাব আর যেনো সহ্য করতে পারে না, তার প্রানের দেবতার প্রতি সবার এমন অবজ্ঞা এই যেন অসহনীয় হয়ে ওঠে তার কাছে । প্রথম প্রথম মুখে মুখেই চলে নিন্দার সুতীক্ষ্ণ বাণ, তারপর শুরু হয় শারীরিক পীড়ন । কখনও কখনও বাবা যখন রাস্তায় বের হন তখন গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাবাকে ধুলোবালি ছুরে মারে । কখনও কখনও পাথর দিয়ে আঘাত করে । ডেঙ্গু চেষ্টা করে বাবার কাছে কাছে থেকে বাবার শরীরটা রক্ষা করার, কিন্তু কাজের চাপে টাকে বাহিরে যেতে হয় তখন উৎপীড়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় । একদিন ডেঙ্গু স্বচক্ষে দেখে , ছেলেরা বাবাকে পাথর দিয়ে আঘাত করছে, আর বাবা তার শরীরটাকে বাঁচাবার জন্য গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আত্তরক্ষার চেষ্টা করছেন ।

চোখ ফেটে জল আসে ডেঙ্গুর, সেই তো জোর করে বাবাকে দাউদকান্দি থেকে বারদীতে টেনে এনেছে । ছেলেদের দলকে তাড়িয়ে দেয় সে, বাবাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে । বাবা চরণ দুটি জরিয়ে ধরে অঝোরে কাঁদে সে – “ কেনো তুমি এদের শাস্তি দিচ্ছো না, কেন একবার দিচ্ছো না, কেনো দেখাচ্ছো না তুমি কে ? তোমার অসীম শক্তি, একবার কি পারনা সবাইকে দেখাতে, সবার চোখ খুলে দিতে । ”

“ ক্ষমাসুন্দর বাবা লোকনাথ ডেঙ্গুর মাথায় তার স্নেহহস্ত বুলিয়ে দেন, বলেন, ওরে ওদের প্রতি রাগ করা কি আমার সাজে ? অরা যে অবোধ শিশু বোঝে না বলেই তো ভুল করে, এদের দোষ আমি কি করে দেখি, আমায় বল । শরীরে পাথর মেরে যে রক্ত বের করবে তারও তো উপায় নেই, পাহাড়ে থাকাকালীন একবার মনে সন্দেহ হলো দেখি তো শরীরের রক্ত কেমন, নিজের পায়ের এক অংশ কাটলাম; কিন্তু রক্ত বের হলো না, গাছের আঠার মতোন এক প্রকার রস বের হয়ে শুকিয়ে গেল । ”

“ আর নিন্দা, অপমান সেও তো বাহিরের জিনিস । আমার আমিটিকে সে যে কখনও স্পর্শ করতে পারে না। একটু ভেবে দেখ, যদি এই কয়েকটা মানুষের দেওয়া নিন্দা, অপমান, শারীরিক পীড়নেই আমি দুঃখী হয়ে কষ্ট পাই, তাহলে আমার হৃদয়ে বহু ভক্তের শরণাগতের দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা – যন্ত্রণা আমি কিভাবে বইব বল ? আমার নিজের কষ্ট বলে যে আর কিছুই নেই, সবার কষ্টই যে হৃদয়ে নিজের মতো করে বাজে, তাকে কিভাবে সহ্য করব ? ”

“ আমার পরমদয়াল সাধন অবস্থায় মনকে বাহ্যিক স্ব অবস্থা থেকে গুটিয়ে নিয়ে নিজের ভেতরে আত্মমগ্ন হবার শিক্ষা আমাকে দিয়েছেন, অনেকটা কচ্ছবের মতন । ইচ্ছামাত্রেই ভেতরে গুটিয়ে নিতে পারি নিজের সব ইন্দ্রিয়কে ।

বাহিরের খোলসটার উপর মান – অপমান, নিন্দা – স্তুতি, সুখ – দুঃখ কতো খলাই হয়ে যাচ্ছে, ওতে আমার নিজস্ব কোনো ইভিমান নেই, তাই এসব থেকে আমি স্বতন্ত্র । ”

জীবন্মক্ত পুরুষ বাবা লোকনাথের মুখে আমারা সহজ সরল করে শুঞ্ছি সেই ভগবদগীতার শাশ্বত গীত – “ দুখেস্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ । বিতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীমুর্নিরুচ্যতে (২/৫৬ ভঃ গীঃ)

তিনিই জীবন্মুক্ত যিনি দুঃখে উদ্বেগশুন্য, যার মধ্যে নেই কোন অনুরাগ, ভয় এবং ক্রোধ তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ, তিনিই মুনি । ‘যঃসরবত্রানভিস্নেহস্তৎপ্রাপ্যশুভাসুভম। নাভিনন্দতিনদ্বেষ্টিতস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ।। (২/৫৭ ভঃ গীঃ)

যিনি পুত্র, মিত্র, দেই ইত্যাদি সব বিষয়ে স্নেহবর্জিত এবং তৎ তৎ শুভ এবং অশুভ প্রাপ্ততে যার মধ্যে অনুরাগ বা দ্বষজনিত বিকার নাই, তিনি স্হিতপ্রজ্ঞা । যদা সংহারতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ । ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠ ।। (২/৫৮ ভঃ গিঃ)

কচ্ছপ যেমন ভীত হলে হস্ত-পদাদি সঙ্কুচিত করে, তেমন যিনি স্বইচ্ছায় নিজের ইন্দ্রেয় সকল বিষয়ে হতে প্রত্যাহার করতে সক্ষম তার প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানো । বাবা লোকনাথ গীতা পাঠ করে শোনালেন না, তিনি গীতা হয়ে দেখালেন গীতার জ্ঞানের সত্যতা ।

আকদিন প্রিয় শীষ্য নারিশাবাবা বাবার কাছে অভিযোগ করলেন, “এই তোমার

কেমন বিচার? লোক তোমার কাছে তাদের বৈষয়িক চাহিদা মেটাবার জন্য মিথ্যার আস্রয় নেয়, আর তুমি তাদের বিনা প্রতিবাদে, আশা-আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছা মিটিয়ে যাচ্ছো?”

গিতামূর্তি বাবা লোকনাথের কণ্ঠ হতে ঝরে পড়ে করুণার নির্ঝরিণী- “ওরে,ওরা যে বড় দুঃখী, ওরা যে বড় অসহায় । ছোট ছোট চাওয়া পূ্রণ করে দেওয়ার কেউ নেই, তাই তো ওরা আমার কাছে কতো কষ্ট স্বীকার করে ছুটে আসে, ওদের দুঃখের কথা আমি শুনি বলেই তো আমার কাছেই ওদের যতো আবদার, অধিকার ।

“সংসারের কঠিন পথে পথে ওরা যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, ওদের মনে ভক্তি বিশ্বাসের ভাব আসবে কোথা থেকে বল?”

“ওদের দুঃখ দেখে আমার দয়া হয়, তাতেই ওদের পাওয়া হয়ে যায় । কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি কিছু করি না । ওদের বিশ্বাস আমিই ওদের দুঃখ দূর করি আমার কথা যখন মানবে না তখন আমার চুপ করে থাকা ছাড়া আর কি উপায় আছে বল ।”

ডেঙ্গুকে কথা দিয়েছিলেন, তাই শত অপমান লাঞ্ছনা সহ্য করেও বাবা ডেঙ্গুর গহে অবস্থান করেন । কি কারণে যে আতদিন নিজের পূর্ণ স্বরূপকে আত্মগোপন করে তিনি লোকালয়ে আসে এক উন্মাদ্গ্রস্ত ভিখারীর মতন যাপন করলেন তা বোঝা সাধারনের পক্ষে কখনই সম্ভব নয় । কিন্তু যেদিন স্ব-ইচ্ছাময় পুরুষ তার নিজের ভগবৎঃস্বরূপের প্রকাস করার ইচ্ছা অনুভব করলেন, সেদিন বারদীর মাটিতেই সর্বসমক্ষে প্রকাশ করলেন তার যোগবিভূতি ।

একদিন বাবা লোকনাথ আপন মনে বারদীর পথ ধরে চলেছেন,

হঠাৎ চোখে পড়ে করেকজন ব্রাহ্মণ এক্তি যজ্ঞোপবীতে গ্রন্থী দেওয়ারকালেঅসাবধানতায় জট পাকিয়ে নিজেদের মধ্যে বেশ ছোটখাট একটি ঝগড়া এবং বিবাদের সৃষ্টি করেছে । বাবা লোকনাথ ব্রাহ্মণদের কাছে এসে তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়ার কারন জিজ্ঞেস করেন । এই পাগলটিকে ব্রাহ্মণেরা অনেকবার ইতিপূর্বে দেখেছে , তাই তিনি কাছে আসতে তারা অস্পর্শের মতনই দূর দূর করে ওঠে । পাগলের ভাবে তাতে কোনই পরিবর্তন দেখা যায় না । জিজ্ঞেস কএরন, “ তোমাদের দেখে ব্রাহ্মণসন্তান বলে মনে হয় । কোন গোত্র তোমাদের ? একজন উত্তর দেন – কাশ্যপ গোত্র । ” শুদ্ধ উচ্চারনের মাধ্যমে পাগল নিজেই বলে – তোমাদের তিন প্রবর – কাশ্যপ, অপ্সর, নৈধ্রুব ।

পগলের মুখে এমন শাস্ত্রের কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হন ব্রাহ্মণেরা, মনে সন্দেহ জাগে কে এই মানুষটি পাগলের ছদ্মবেশে ?

“ পৈতেতে জট পাকিয়ে গেলে তা কেমন করে খুলতে হয় তোমরা জানো না ? ” -প্রশ্ন করলেন পাগল ।

“গায়ত্রী মন্ত্র জপ করলে পৈতেতে জট খুলে যায় ” -উত্তর দের ব্রাহ্মণেরা ।

“ তবে জপ কর না কেন ? ” আবার প্রশ্ন পাগলের ।

“ করছি তো, কিন্তু জট তো বেড়েই যাচ্ছে । ” – অসহায় ভাবে উত্তর দেয় এক ব্রাহ্মণ ।

“ আচ্ছা, তবে তোমরা পৈতের দুটি শেষ ভাগ ধর, আমি মন্ত্র উচ্চারণ করছি ”

– এই বলে অপরূপ সুললিত কণ্ঠে বেদেরঋষির মতন গায়ত্রী মহামন্ত্র উচ্চারণ করেন বাবা লোকনাথ । তার শুদ্ধ উচ্চারণ এবং ভাবগম্ভীর কণ্ঠস্বরে যেন আকাশ বাতাস মুহূর্তের মধ্যে মুখরিত করে তোলে । ব্রাহ্মণেরা সবিনয়ে দর্শন করেন মহাশক্তি এবং বাবার অলৌকিক যোগবল মুহূর্তের মধ্যে পৈতেটি সরল হয়ে যায়, কোথাও থাকে না এতটুকু জট । বুঝতে বাকি থাকে না ব্রাহ্মণেদের যে এই পাগল কোনো সাধারন ভিখারি সাধু নন , অসাধারণ যোগবিভূতি সম্পন্ন মহাসাধক, মহাযোগী । মহাপুরুষের চরণ ধরে তারা ক্ষমা ভিক্ষা করে, বলে – “আপনাকে আমারা চিনতে ভুল করেছিলাম, আপনি কৃপা করে আমাদের ভ্রান্তির অবসান করেছেন, আপনি আমাদের ক্ষমা করুন ।

একটি ছোট ঘটনা, কিন্তু যে বিন্দুর মধ্য দিয়েই সিন্ধুর লীলা দেখাবেন ক্ষুদ্রের মধ্যে, অনুর মধ্যে যে সেই বিরাটের খেলা, এই পরমসত্যকে জগতবাসীর কাছে দেখাবার জন্যই তো তা আগমন । এই ছোট্ট ঘটনাটির অলৌকিকত্ব এবং ব্রহ্মচারী বাবার যোগশক্তির কথা মুখে মুখে দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম হতে গ্রামান্তরে, দেশ হতে দেশান্তরে ।

ডেঙ্গুর ছোট্ট কুটির রূপান্তরিত হল এক পবিত্র তীর্থে । শত শত নরনারী চতুর্দিকে থেকে ছুটে আসে লোকনাথের চরনাশ্রয়ে ।

এই লীলা দর্শন করা ডেঙ্গুর ভাগ্যে কয়েকদিনের জন্য লিখিত ছিল, তাই কিছুদিনের মধ্যে ডেঙ্গু ইহজগত ছেড়ে ছলে যায় বাবার কোলে । ডেঙ্গুর মৃত্যুর পর পরিবারের অনেকেই বাবা লোকনাথের ডেঙ্গুর গৃহে থাকা পছন্দ করে না । একথা তাকে স্পষ্ট জানানো হয় । নির্লিপ্ত বাবা লোকনাথ জবাব দেন – যোগী পুরুষের জন্য সমগ্র বিশ্বই গৃহ সমান ।

আমি এখনই চলে যেতে প্রস্তুত; কিন্তু তোরা যে কাজটা ভাল করছিস না, তাই তোদের মঙ্গলামঙ্গলের কথা চিন্তা করেই আমি ভয় পাচ্ছি । ” বাবা লোকনাথের ডেঙ্গু কর্মকারের গৃহে অবস্থান কালে ডেঙ্গুর আর্থিক উন্নতি যে বাবারই কৃপা নিহিত ছিল টা ডেঙ্গুর পরিবারের মোহগ্রস্থ লকেরা বুঝতে পারে না । তাই ডেঙ্গুর গৃহ ছেড়ে বাবা চলে যেতে না যেতেই অতি অল্পদিনের মধ্যেই মহাপুরুষকে অমর্যাদা করার জন্য, সমস্ত সম্পত্তিই নষ্ট হয়ে যায় । বাবা এই ভবিষ্যৎ দর্শন করেই চিন্তিত হয়েছিলেন । বারদীর নাগ পরিবার তখন বারদীর সব থেকে ধনী জমিদার । বাবা লোকনাথের লীলার কথা তাদের মনেও নিয়ে আসে বাবার প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি এবং বিশ্বাস । বহুভাবে মহাপুরুষদের সেবা করে এই পরিবার বাবা লোকনাথের কৃপাধন্য হয় । ডেঙ্গু কর্মকারের গৃহে বাবা আর থাকতেন না, এই খবর তাঁদের কানে পৌঁছায় । নাগ পরিবার যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন । তারা সমবেতভাবে শরণাপন্ন হন, জানান অন্তরের নিবেদন, বাবার পছন্দ মতন জায়গা বাবা নিজেই ঠিক করুন, তার উপর নির্মাণ করবেন তারা বাবার আশ্রম, সেখানেই বাবা বিরাজ করবেন এই তাঁদের আন্তরিক ইচ্ছা ।

নাগ পরিবারের শ্রদ্ধা ভক্তির পরিচয় বাবা অনেকভাবে জন সমাজের কাছে তুলে ধরেছেন ইতোপূর্বে । তাই ভক্তের প্রার্থনা মধ্যে নির্ধারিত লীলা স্থানটি বাবা তার দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পান , বলেন, “ যদি কোন নিষ্কর ভূমি দিতে পার তাহলে আমি রাজি আছি । ”

ছাওয়াল বাঘিনী নদীর তটে এক্তি পরিত্যক্ত জমি টা এতদিন শ্মশানভূমি রূপেই ব্যবহৃত ছিল ঐ একমাত্র নিষ্কর; কিন্তু স্থানটি যে শ্মশানভূমি, তাই ইতস্ততঃ করেন নাগ পরিবারের ভক্তজন । কিন্তু ঐ স্থানটি যে নির্ধারিত, ঐ শ্মশাননেই লীলায় প্রকট হবেন জীবন্ত কালী – মহাকালী ।

বাবার আদেশ লাভ করে ঐ জমির উপর নির্মিত হয় বৈদিক রিশিদের বাসগৃহের মতোন অপরূপ পূর্ণ কুটির । দিনে দিনে ফুলে ফুলে পত্রপুষ্পে স্থানটি রূপান্তরিত হয় এক মহাতীর্থে । বারদীর আশ্রমের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, রচিত হয় এক মহাসঙ্গম , যেখানে হিন্দু , মুসলমান, বৌদ্ধ ,খ্রিস্টান – সর্বজাতি সর্বধর্ম সমগ্র মানবজাতির মহামিলন হয়, জীবন্মুক্ত সাক্ষাৎ পরম শিরের প্রেম এবং করুণার চরণছায়া ।

অমৃত কথা



“স্বতঃ, রজঃ ,তমঃ এই তিন গুনের যে কাজ তাই ধর্ম । যার যে গুন, টা অতিক্রম করে ভ্রমবশতযে যে কাজ করে তাই তার পক্ষে অ ধর্ম । ”
-শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

“সংসারে থাকতে গেলেই সুখ – দুঃখ আছে আধটু অশান্তি আছে । কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে একটু কালি লাগবেই । ”
-শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ

মূর্তগীতা লোকনাথ

সনাতন ধর্ম অসম্প্রদায়িক বিশ্বাসের ধর্ম । বিশ্বাস নিজের উপর, সকলের উপর বিশ্বাস । ঈশ্বরীয় প্রেম সকলের প্রতি মৈত্রিবন্ধন অটুট রাখে । শ্রীশ্রী গীতা গ্রন্থ। এর জন্যই মানুষের কণ্ঠেগীত হয়। বল গীতার জয়, বল গীতার জয় গীতাপড়ে, গীতা শুনে সকল পাপ হয়।

বাবা লোকনাথের কেন ‘মূর্তগীতা ’বলা হয় ? গীতা পড়লে বা শুনলে মহাপাপীরও পাপ মুক্ত হয় । বাবা লোকনাথের কৃপা হলে মহাপাপীর সকল পাপ পাপ মুক্ত হয় ।

(১) এক ভক্ত তপস্বী নারিশাবাবার জীবনে কিভাবে এই মহাযোগী বাবার কৃপাধারা নেমে এসেছিল । কিভাবে ঘটেছিল এক অত্যাশ্চর্য রূপান্তর । তা সত্যিই মহাযোগীর বাবা লোকনাথের অলৌকিক যোগশক্তির এক অসাধারণ উদাহরণ । বাল্যকালেই এক নাগা সন্ন্যাসীর পল্লায় পড়ে নারিশাবাবা হয়েছিল এক ভক্ত সন্ন্যাসী । সন্ন্যাসীর বেশ নিয়ে সহজ পথে কিভাবে ইন্দ্রিয় তৃপ্তির ব্যবস্থা করা যায় তা অল্প বয়সেই আয়ত্ত করে ফেলে । তাই অল্প বয়সেই গুরুর সঙ্গ ছেড়ে নিজেই গুরুগিরির ব্যবস্থা শুরু করে । ছেলাবেলা জুটতেও দেরী হয় না । সন্ন্যাসীর বেশ নিয়ে গাঁজা আফিমের মধ্যে নিজেরাও যেমন খুঁজে পায় ইন্দ্রিয় সুখের খোরাক । গ্রামে গ্রামে ভ্রমনকালে এই নেশার বস্তুগুলির ব্যবসাও জমে ওঠে তাদের । রাতের অন্ধকারে গ্রামে থাকাকালীন কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার পণ্যও ছেলেরা শুরুতে মদদ দেয় । নিজেও ভোগ করে । এই ভাবেই বহু বছর চলে যায় । মনের মধ্যে আসে না কোনো অনুশোচনা । সহজ সরল গ্রামবাসীর সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে জীবনটা বেশ কাটতে থাকে নারিশা বাবার ।

একদিন গাছপালার ধুনি জ্বেলে ভস্ম মেখে সে যে বসে আছে । মনে মনে চলছে ইন্দ্রিয়ভোগের পরবর্তী পরিকল্পনার চিন্তা, হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে তার পূর্বাশ্রমের নামতি ধরে গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে ওঠে ।

এমন অসাধারণ কণ্ঠ সুর সে তো কোনোদিন শোনেনি, ডাক শোনাই যেনো অজানা আশংকায় তার মন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে । পিছনে সে মানুষকে সে দেখেন তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি এবং জ্যোতির্ময় দেহ তাঁর অন্তরে জগতে তোলে এক অস্বাভাবিক আলোড়ন । তার নিজের অজান্তে সে নিজেকে সমর্পণ করে তাঁর চরণে। সে চরণস্পর্শে যে কি এক যাদু, তাঁর মনের এত দিনের গ্লানি, রাশিকৃত পাপ সব যেন মুছে যায়। কেবল তার চোখের জল আর থাকতে চায় না। স্নেহময়ী জননী যেমন সন্তানের সব পাপ ক্ষমা করে সন্তানকে বুকে নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না ঠিক তেমনি প্রেমময় লোখনাথ নারিশা বাবার সকল অপরাধ ক্ষমা করে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নেন। সব অপরাধের জন্য নিজেকেই করেন দায়ী। যদি তিনি হিমালয় হতে কিছু কাল আগে আসতেন তাহলে তাঁর সন্তান আমন ভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াতেন না এমন ক্ষমা যে কোন মনুষ্য শরীরে সম্ভব তা যেন নারিশা বাবার কল্পনার বাইরে। অতীত জীবনে কোনো ঘটনা তার অজানা এ কথা ভাবতেই পারে না। তিনি তবু যখন তার সব দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তার আনন্দের সীমা থাকে না। জীবনের আর একটি দিনও যে এই মানুষটির পরম কল্যাণময় সত্য ছাড়া থাকা সম্ভব এ যেনে নারিশা বাবার স্বপ্নেরও অতীত। বাবা লোকনাথের সামান্য কৃপাতেই নারিশা বাবার মতো পাপিষ্ঠের জীবনে ঘটে গেল এমন পরিবর্তন যাহা সে কোনো দিন ভাবেনি নারিশা বাবা। বাবা লোকনাথের কৃপার ফলেই নারিশা বাবা ভক্তসন্ন্যাসী থেকে পরিণত হলো মহাসাধকে।

(২) বারদী হাই স্কুলে এক পণ্ডিত ছিলেন, নাম তার বিপিন বিহারী সরকার।

তিনি ছিলেন কিছুটা অহংকারী। একবার তার মনে হলো বাবা লোকনাথকে দর্শন করতে যাবেন এবং শাস্র নিয়ে আলোচনা করবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বাবা লোকনাথকে দর্শন করার জন্য বাবার মন্দিরে আসেন। বাবা লোকনাথ বেল তলায় বসে আছেন আত্মময় হয়ে। পণ্ডিত মহাশয় শাস্রের উপর আলোচনা শুরু করলেন। এমন সময় একটি কাক এসে আমগাছের ডালে বসে ডাকতে লাগল। বাবা লোকনাথ সব জীবের ভাষা বুঝতে পারতেন। কাকটি ডিমে তা দিয়ে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। জীব মাত্রই সন্তানের জন্ম দিতে মা কষ্ট করেন। ডিমে তা দিয়ে কয়েক দিন অনাহারে রয়েছে। কাক স্তন্যপায়ী জীব নহে। কাক নিজের খাবার এবং সন্তানের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করবে। কাকের কর্কশ স্বর পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে মোটেই ভালো লাগছিল না। তিনি একটি ঢিল মেরে কাকটিকে তাড়িয়ে দিলেন। পণ্ডিত মহাশয়ের ব্যাবহারে বাবা লোকনাথ কষ্ট পেলেন কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পরে আবার কাকটি গাছের ডালে বসে ডাকতে লাগল। তখনও পণ্ডিত মহাশয় আবার একটি ঢিল মেরে তাড়িয়ে দিলেন। এই দৃশ্য বাবা লোকনাথ অবলোকন করেন এবং বাবা ব্যথিত হলেন। বাবা লোকনাথ পণ্ডিতকে বললেন এই কাকটিকে তাড়ালেন কেন। আপনি যেমন আমার অতিথি, এই কাকটিও আমার অতিথি। কাকের চাহিদা আপনার চাহিদার চেয়ে বেশি।

আপনার ভিতরে যেমন আত্মারূপে শ্রীভগবান বিরাজ করছেন। এই কাকটির ভিতরেও তেমনি শ্রীভগবান বিরাজ করেছেন। আপনি দেখেন একটি কালো কাক, আর আমি দেখি কাকের ভিতরে শ্রীভগবানকে। এখানে আপনার ও আমার দর্শনের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। আপনি দেখেন কোনো জীবের বহিররঙ্গ রূপ আর আমি দেখি জীবের মধ্যে চৈতন্য স্বরূপকে। মায়ার কারণে আপনার এই ভেদদর্শন হয়।

মায়ার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে দেখতে পারবেন জীবের স্বরূপ। মায়া কি করে জানেন? মায়া আমাদের জীবের প্রকৃত স্বরূপ দেখতে দেয় না। এই মায়া শ্রীভগবানের শক্তি। শ্রীগীতাতে শ্রীভগবান প্রিয় সখা অর্জুনকে বলেছিলেন শ্রীভগবান সুন্দর এবং তাঁর সৃষ্টিও সুন্দর। আমাদের অজ্ঞাণজনিত দৃষ্টির কারণে আমরা ভেদ দর্শন করি। শ্রীভগবানকে সুন্দর বলে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস হলে তাঁর অনন্ত সৃষ্টিকেও সুন্দর না দেখে পারে না। গীতার এই শিক্ষাই জগৎ জীবের প্রকৃত শিক্ষা। দেখুন অন্তরে সতত ভগবৎ ভাবনা থাকে তখনই তাকে সর্বত্র দেখা যায়। আমাদের মনকে শ্রীকৃষ্ণ অনুরাগে রঞ্জিত করতে পারলেই জীবন সুন্দর হয়। শ্রীভগবান সর্বত্র বিরাজিত আছেন বহুরূপে। আমরা বুঝি না বলেই জীবনভর তাঁকে খুঁজে মরি। আমাদের হৃদয় মন্দিরেও তিনি(ভগবান) বিরাজ করছেন। আমাদের ইন্দ্রিয় সকল বহির্মুখী বলেই তাই অন্তরদৃষ্টি হয় না। এই কারণে আমাদের হৃদয়ে স্থিত শ্রীভগবানকে দেখতে পারি না। ভগবান সকলের হৃদয়ে আছেন এই কথাটিও আছে শ্রীমদভগবদ গীতাতে।

কী সুন্দর কথা! হৃদয় বিহারীকে নিজ হৃদয়েই খোঁজা প্রয়োজন। আপনি হয়তো বলবেন এ সকল কথা আগে ভাবেননি। বিশ্বব্যপিয়া পাঠশালা আছে। আমরা সকলেই এই পাঠশালার ছাত্র। শিক্ষার শেষ নেই। শাস্রে বলা হয়েছে ব্রহ্ম যেমন অনন্ত জ্ঞানও তেমনি অনন্ত। যে জ্ঞান আত্মচৈতন্য জাগায় তাকেই জ্ঞান বলে। এছাড়া অন্য গুলি জ্ঞানের আওতায় পড়ে না। আপনি স্কুলে পাঠ দান করেন। জ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শ্রীভগবান ভক্তপ্রবর অর্জুনকে বলেছেন, “অমানীতা, আন্তরিকতা, ক্ষমা, সরলতা, গুরুসেবা, সৎকার্যে একনিষ্ঠা, আত্মসংযম, আমাতে(কৃষ্ণ) ঐকান্তিক উশী, পবিত্র নির্জন স্থানে বাস ইত্যাদিকেই বলা হয় জ্ঞান এবং বিপরীত হলো অজ্ঞান।”

গীতায় তেইশটি গুণের উল্লেখ আছে। মানুষ এইগুলিকে নিজের চরিত্রে ধারণ করতে পারলেই কেউ জ্ঞানী পদবাচ্য হতে পারেন। অন্যথায় নয়। মানবজীবনে এই গুনগুলির একান্ত প্রয়োজন। এই সকল গুণের অনুপস্থিতির কারণে মানব সভ্যতা বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের সঙ্গে পারমার্থিক জ্ঞানের সমন্বয়ে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপিত হতে পারে। ছাত্র সমাজে মানব কল্যাণমুখী এই গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হলে নিজেকে এই গুণে গুণান্বিত হওয়া একান্ত আবশ্যক। নিজের জীবনে সুন্দর গুণের আচরণ না থাকলে সমাজে তা বিতরণ করা যায় না। একজন শিক্ষক সমাজকে আলো দান করেন। তাই আপনার সঙ্গে আমার এই কথাগুলি হলো।

আপনি আমার সঙ্গে যে কথাগুলি বলেছিলেন তাও আমার রুচিসম্মত হয়নি, তবু আপনার কথা আমি স্রবণ করেছি। সব কথা সুন্দর হবে তাও ঠিক না। এ সমুদয়কে সহজভাবে গ্রহণ করার অভ্যাস আমাদের জীবনে করা উচিত। আজ স্বাধীন এই কাক পক্ষীটির প্রতি যে রূঢ় আচরণ করা হলো এমনটি আর জীবনে হবে না বলে আমি বিশ্বাস করি। বাবা লোখনাথের কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করলেন স্কুল শিক্ষক বিপিন বিহারী সরকার। লোখনাথ বাবার কথামৃত শ্রবণ করে বারদীর বাবার দুই চরণ জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন আমি অজ্ঞান। সারাজীবন শিক্ষকতা করেছি, মনে একটা অহংবোধ ছিল অনেক কিছুই জানি। আজ সুযোগ পেয়ে আপনার চরণতলে এসে জীবনের এমনটি ভুল ভাঙল। জীবনে কিছুই জানা হলো না। আপনার সন্নিকটে আসার সুযোগ পেয়ে ক্ষণিকের মধ্যে যে জ্ঞান আমি লাভ করলাম, আজীবন আমি আর থেকে লক্ষযোজন দূরে ছিলাম। আমার সৌভাগ্য যে আমার মতো হীন পতিতকে উদ্ধার করার জন্য এতক্ষণ জ্ঞানামৃত শোনালেন। আপনার প্রতিটি কথাই আমার কর্ণ দিয়ে প্রবেশ করে আমার অন্তরে দাগ কেটেছে। আপনার কথা যতোই শুনছিলাম ততোই আনন্দ বোধ হচ্ছিল।

এই সুখ আমার জীবনে লাভ হয় নাই। তাই সকাতরে নিবেদন করছি, বাবা আমার অজ্ঞানজনিত অপরাধ ক্ষমা করবেন। আমার মতো পতিতকে আপনার পদতলে স্থান দিন। এই বলে বিপিন বিহারী সরকার বাড়ির দিকে রওনা হলো। পরবর্তীতে বিপিন বিহারী সরকার বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েছিলেন।

আমি একজন সাধারণ মানুষ ও ভক্ত এই দুইটি কাহিনী হতে এই সিধান্তে উপনীত হই যে বাবা লোকনাথ মানব রূপে ভগবান ও মূর্তগীতা যথার্থ সত্য।

বারদীতে ধনাঢ্য সম্মানিত নাগ চৌধুরী পরিবার ও বাবা লোকনাথের আশ্রম প্রতিষ্ঠা এবং পাদুকা উৎসব প্রচলন

বারদীতে বাবা লোকনাথের সেবাইত ধনাঢ্য সম্মানিত নাগ চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ কন্যাকুজ হতে আগত দশরথ নাগ। তিনি প্রথম আদি পুরুষ। ষোল জেনারেশন পরে ঐ আদি বংশের তিনটি ভাগ হয়- ১. পশ্চিম হিস্যা, ২. পূর্ব হিস্যা, ৩. পাঁচ হিস্যা। ঐ পাঁচ হিস্যার ২২ তম বংশধর উমেশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী বারদীতে বাবার আশ্রম স্থাপনের জন্য নিজেদের নিষ্কর শ্মশান ভূমি নির্দিষ্ট করেন। বাবা লোকনাথের পছন্দ মতো স্থানে জমিদার উমেশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী বাবা লোকনাথের আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে উক্ত ভূমি উৎসর্গ করেন। উমেশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী বাবা লোকনাথের আশ্রমের প্রথম সেবাইত।

১৯৩১ সালে কতিপয় কু-চক্রিদের চক্রান্তে তৎকালীন সেবাইত প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরীর বিরুদ্ধে নিন্ম আদালতে একটি মামলা করেন। বারদীর জমিদার প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী বারদীর মন্দিরের সেবাইত থাকতে পারবে না এই মর্মে একটি রায় দেয়। ১৯৩২ সনে প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী জজ কোর্টে পুনরায় সেবাইত নিয়ে নিন্ম আদালতের মামলাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেন।

প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী পুনরায় একটি মামলা করেন। প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী জজ কোর্টের এই মামলায় হেরে যান। ১৯৩৫ সনে কলকাতার হাইকোর্টে প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী পুনরায় একটি মামলা করেন। ঐ মামলায় প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরীর পক্ষে রায় দেয়।

এতে প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরী বারদীতে লোকনাথ মন্দিরের সেবাইত ও মালিক হন। প্রকাশ চন্দ্র নাগ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে জ্যোতিপ্রসাদ নাগ চৌধুরীর সেবাইত হন। জ্যোতিপ্রসাদ নাগ চৌধুরীর ৭ ছেলে ও দুই মেয়ে এবং দুই স্ত্রী। প্রণব, প্রবীর, প্রভাস, প্রশান্ত, প্রদীপ, প্রলয়, প্রণয়, মেয়ে দুর্গা ও গোপা। স্ত্রী- সাবিত্রী, শোভারানী।

১৯৮৭ সনে ১০ই জানুয়ারি জ্যোতিপ্রসাদ নাগ চৌধুরীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে জ্যোতিপ্রসাদ নাগ চৌধুরী তার সাত পুত্রের নামে বারদীর বাবা লোকনাথ মন্দিরের সেবাইতের নাম বর্তায়। কিন্তু জ্যোতিপ্রসাদ নাগ চৌধুরীর কথা মতো তার দুই ছেলের নামে কার্ড ছাপানো হয়। যতদিন বাবা লোকনাথের আশ্রম বারদীতে থাকবে ততোদিন সে সাথে যুক্ত থাকবে পাঁচ হিস্যা নাগ বংশের আগত বংশধরদের নাম। বাবা লোকনাথ বলেছিলেন ওরে আমি বারদীতে এসেছি কেন? জান নাগ চৌধুরী পরিবার বংশধরদের সাথে আমার একটি গভীর টান আছে। ওদের দোষ আমি দেখি না। বাবা লোকনাথের এই উক্তিতে নাগ চৌধুরী বংশের বংশধরেরা ধন্য হয়েছেন।

শ্রীশ্রী পাদুকা উৎসবের মাহাত্ম্যঃ
পুণ্যভূমি বারদী শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার আশ্রমে প্রতি বছর ১২ই ফাল্গুন পাদুকা উৎসব পালিত হচ্ছে।

পাদুকা উৎসবের পটভূমিঃ
বাংলা ১২৯৭ সালের ১৯ শে জ্যৈষ্ঠ বাবা লোকনাথের দেহরক্ষার পরবর্তী সময়ে আসনগৃহে বাবা লোকনাথের বৃহৎ তৈলচিত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বাবার ফটোমূর্তির সম্মুখভাগে বাবা লোকনাথের ব্যবহৃত পাদুকাযুগল নিত্য সেবাপূজার নিমিত্ত স্থাপন করা হয়। পূজাহরিগণ যথা সময়ে ও যথা নিয়মে বাল্যভোগ ও রাজভোগ নিবেদন করে থাকেন। প্রাত্যহিক সন্ধ্যারতির পর বাবার নাম সংকীর্তন শেষে শান্তিবারি, চরণামৃত ও উপস্থিত ভক্তগণের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়ে থাকে।

আজ প্রায় অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল গত হতে চলল আমাদের জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনার কথা হৃদয় মাঝে এখনও উজ্জল হয়ে আছে। সে সময়টা সমম্ভবত বাংলা ১৩৫৪-৫৫ সন বা নিকটবর্তী সনের ১২ই ফাল্গুন। ১২ই ফাল্গুন প্রত্যুষে আমরা জানতে পারলাম, আসনগৃহে স্থাপিত বাবা লোকনাথের ব্যবহৃত কাষ্ঠ পাদুকাযুগল যাহা নিত্যপূজা অর্চনা করা হয়ে থাকে, উহা বিগত দিবস ১১ই ফাল্গুন সন্ধ্যারতির সময় ধূপতি হতে জ্বলন্ত অঙ্গার অসতর্ক মুহূর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে ভেলভেট কাপড়ের উপর পড়ে। যার উপর বাবার পাদুকাযুগল স্থাপিত ছিল। নিক্ষিপ্ত জ্বলন্ত অঙ্গারে ভেলভেট কাপড়খানা ঘুসঘুসে আগুনে জ্বলে পাদুকা যুগলও ভস্মীভূত করে ফেলে, কিন্তু বৌলা দু’খানা ভস্মীভূত হতে পারেনি। উক্ত দুঃসংবাদ অচিরেই বায়ুবেগে গ্রাম হতে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। বারদী ও তৎ সন্নিহিত অঞ্চলের এবং কয়েক ক্রোশ দূরবর্তী গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা আশ্রম প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হতে থাকে।

ভক্তগণের মন বিষণ্ণ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। অনেক ভক্ত উক্ত ঘটনাকে সমাজের ভাবী অমঙ্গলের আশঙ্কায় বিষাদগ্রস্থ হন। কোন কোন মহিলা ভক্ত আসন ঘরের বারান্দায় দুগ্ধ ও জল ফেলে বাবার চরণ ধৌত করেন। সে সময় বাবার আশ্রমের প্রধান পুরোহিত ছিলেন স্বর্গীয় গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়, কিন্তু ১১ই ফাল্গুন

তারিখে অপর একজন পুরোহিত বাবার মন্দিরে ভোগ নিবেদন ও সন্ধ্যারতির কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁহার অসাবধানতায় এ ঘটনা ঘটে। পাদুকা ভস্মীভূত হওয়াজনিত অমঙ্গলের আশঙ্কা দূরীকরণার্থে খোল করতাল সহযোগে যথারীতি নাম সংকীর্তনের আয়োজন করা হয়। সমস্ত দিনব্যাপী নাম সংকীর্তন চলতে থাকে ও ভক্তগণের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এভাবে দেশবাসীগণ সকল প্রকার দুশ্চিন্তা ও বিসাদ হতে মুক্ত হন। এর পর হতে প্রতি বছর ১২ ই ফাল্গুন দিনটি উৎসব হিসেবে পালন হয়ে আসছে এবং ইহা “পাদুকা উৎসব” নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রথম কয়েক বছর বারদী ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের ভক্তগণ এবং বিশেষভাবে নারায়ঙ্গঞ্জস্থিত কাপড় ব্যবসায়ী ভক্তগণের উতসাহ-উদ্দীপনা ও সাহায্য সহযোগিতায় “পাদুকা উৎসব” সম্পন্ন করা হত। ক্রমে বছর অতিক্রান্ত হতে থাকে পাদুকা উৎসবের আয়োজন ও ভক্ত সমাগম বারতে থাকে। বর্তমান সময়ে “পাদুকা উৎসব” এক বিশাল উৎসবের আকার ধারণ করেছে, স্থানীয় ও দূর-দুরান্ত হতে আগত ভক্ত সমাগমে আশ্রম ভূমি মুখরিত হয়ে ওঠে, ভক্তগণ বাল্যভোগ ও রাজভোগের প্রসাদ গ্রহণপূর্বক অপার আনন্দ লাভ করে থাকেন। এভাবে আশ্রমে প্রতি বছর ১২ ই ফাল্গুন “পাদুকা উৎসব” পালনের রীতি প্রচলন হয়।

উল্লেখ্য যে, বর্তমানে বাবার বিভিন্ন আশ্রম ও মন্দিরে সমারোহে পাদুকা উৎসব পালিত হচ্ছে।

জয় বাবা লোকনাথ,জয় মা লোকনাথ,জয় গুরু লোকনাথ,জয় শিব লোকনাথ,জয় ব্রহ্ম লোকনাথ।

অমৃত কথা

“ঈশ্বরই একমাত্র সদগুরু। আমার চরণ ধরিস না- আচরণ ধর।”
--শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

কৃতজ্ঞতা শিকারঃ
“পাদুকা উৎসবের পটভূমি” শীর্ষক লেখাটি বারদীস্থ প্রবীণ লেখক ও বাবা লোকনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত স্বর্গীয় হরিভক্ত বণিক মহাশয়ের লেখা থেকে সংকলিত হয়েছে।

বারদীর মহাযোগী বাবা লোকনাথ ও ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী

মহাযোগী বাবা লোকনাথ ও রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ উভয়ের জন্ম সুজলা- সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বঙ্গে। উভয়ের জন্ম ব্রাহ্মণ পরিবারে। মহাযোগী বাবা লোকনাথের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁকড়া কচুয়া গ্রামে। রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের জন্ম পূর্ববঙ্গের ভাওয়াল রাজ্যে। বর্তমান গাজীপুরে।

বাবা লোকনাথ মানবরূপে ভগবান। রাজেন্দ্র নারায়ণ ভাওয়াল রাজ্যের দয়ালু রাজা। বাবা লোকনাথ লোক শিক্ষার জন্য বারদীতে আসেন। বারদীর আশ্রমে বাবা লোকনাথ বসেন কল্পতরুরূপে। দূর-দূরান্ত হতে কতো লোক আসে সাক্ষাত ভগবানের নবরূপ দর্শন করার জন্য। বাবা অকাতরে প্রেম বিতরণ করে যাচ্ছেন, কিন্তু এ যেন অমৃতসিন্দু , বিলিয়ে শেষ করা সম্ভব নয়। তাঁর অনন্ত করুনাসাগর হতে ভক্তগণ দুই এক বিন্দু কৃপা লাভ করেই কতো কৃতার্থ হন।

ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের কানে পৌঁছায় বারদীর বাবা লোকনাথের অসাধারণ অপরূপ লীলা ও করুণালীলার কাহিনী। মনে এক দুর্নিবার ইচ্ছা অনুভব হয় মহাযোগীকে দর্শন করার। ভক্তের মনোবাসনা ভগবান পূর্ণ করেন। রাজেন্দ্রনারায়ণ সপারিষদ যাত্রা করেন বারদীর উদ্দেশ্যে। পথে চলছেন রাজা, সঙ্গে পাত্র-মিত্র, সন্ন্যাসী দর্শন করবেন এই অভিলাস, কিন্তু সন্ন্যাসীর জাতি সম্মন্ধে কিছু জানা নেই, সেমত অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কেউ সন্ন্যাসীর চরণ স্পর্শ করে বা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করবেন না। রাজার আদেশ সবাই স্বীকার করে নেন।

কিন্তু বারদীর আশ্রমে পৌঁছে সাক্ষাত শিবকল্প মহাযোগীর অপরূপ দর্শন করে রাজেন্দ্র নারায়ণ মন্ত্র মুগ্ধের মতো পরম স্রধাযুক্ত চিত্তে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন। তা দেখে তাঁর সঙ্গে আগত সকলে বাবার চরণধুলি মাথায় নেন।

শিশুর মতো বাবা হাসছেন। বাবা রাজাকে বললেন, বাবা তোমরা যে আমাকে প্রণাম করবে না স্থির করে এসেছিলে। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় রাজার এবং সঙ্গে আগত পরিষদবর্গের, অন্তর্যামী ভগবান তাদের পথের মধ্যে আলোচিত সব কথাই বারদীতে বসে শুনেছেন, একথা বুঝতে বাকি থাকে না। নিজেদের

অজ্ঞতা এবং অভিমানের অপরাধের জন্য অন্তরে অন্তরে ক্ষমাভিক্ষা চান তারা বারবার। বাবা লোকনাথের চক্ষু আকর্ণ বিস্তৃত। চক্ষু যুগলের তেজ এবং যোগ ঐশ্বর্যের এমনি প্রভাব ছিল যে, শুধু গৃহী ভক্ত নয়, আশ্রমে আগত বহু সাধু-সন্ন্যাসীরাও তাঁর মূর্তি দর্শন করে তাঁর চরণে প্রণাম করে ধন্য হতেন। তার বাবাকে অতি সহজে জগিরাজ বলে সম্বোধন করে জয় জয় করেন।

বাবা লোকনাথের অপার মহিমা দর্শন করে ভাওয়ালের রাজা বাবার একনিষ্ঠ ভক্তরূপে রূপান্তরিত হন। বাবাকে তিনি জীবন্ত শিবজ্ঞানে পূজা করতে শুরু করেন। রাজকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে কিংবা পারিবারিক সকল ব্যাপারে তিনি বাবার আদেশ সরবাগ্রে আশীর্বাদ স্বরূপ প্রতিপালন করতে থাকেন এবং বাবার আশীর্বাদে তার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হয়। মনে বাবার প্রতি অনুরাগ এবং ভক্তি তার এতই প্রগাঢ় হয়ে ওঠে যে, তিনি বাবাকে না দেখে বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। তাই মনে মনে স্থির করেন, লোকে যেমন মন্দির করে শিব প্রতিষ্ঠা করে,

তেমনি তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে এক বৃহৎ মন্দির নির্মাণ করে তার প্রানপ্রিয় জীবন্ত শিবকে তাঁর কাছে এনে প্রান দিয়ে সেবা করে জীবন ধন্য করবেন। একথা তিনি বারদীতে বাবাকে অতি বিনীতভাবেই নিবেদন করেন; কিন্তু বারদীই যে বাবার চিন্হিত মহিতীর্থ, তাই সহজভাবে ব্যক্ত করে শান্ত করেন তাঁর প্রিয় সন্তানকে, “তবে আমায় নিয়ে যাবার জন্য তো ব্যস্ত হয়ে উঠেছিস কেন? আমি যে সর্বদাই তোর সঙ্গে আছি, আমি যে সর্বদাই আছি রে। এই শরীরটাকে নিয়ে টানাটানি করে কি হবে? আমি কি শরীর?”

এমন কথার পর আর কোন কথাই রাজা বাহাদুর বলতে পারলেন না, কেবল তাঁর কৃপাভিক্ষা চান। এই ভাওয়ালের রাজার প্রতি শ্রীশ্রী লোকনাথ আশ্রিত অগণিত ভক্ত চিরকাল কৃতজ্ঞ, কারন বাবার একমাত্র আলোকচিত্রটি রাজার আগ্রহ এবং অপরিসীম ভক্তির ফলেই আমরা লাভ করেছি। ঐ আলোকচিত্রটির থেকে অনেক তৈলচিত্রই কালক্রমে তৈরি হয়েছে বা হচ্চে, কিন্তু মূলটি তারই একনিষ্ঠ ভক্তির ফল।

সর্বোতভাবে প্রচার বিমুখ বাবা লোকনাথের আলোকচিত্র গ্রহণের লীলাটি সত্যিই অতি মধুর।

একদিন রাজা বাহাদুর হস্তিপৃষ্ঠে তখনকার দিনের ফটো তোলার যন্ত্রাদিসহ বাবার আশ্রমে সদলবলে উপস্থিত হন এবং মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন, কারণ ইতিপূর্বে কেউই বাবার ছবি তুলতে সক্ষম হননি। ফটো তোলার কথা শুনতেই বাবা বেশ রেগে ওঠেন, বলেন, “ এই অনিত্য দেহ একটি খাঁচার মতন। এই খাঁচার আবার ছবি তুলে কি হবে? যা যা আমার কোনো ফটোর দরকার নেই।”

ভক্তি ও বিনয় মিশ্রিত কণ্ঠে রাজা বাহাদুর নিবেদন করেন তার অন্তরের সঙ্কল্প। বলেন- বাবা, এতদুর পথ এত যন্ত্রাদিসহ আমি এসেছি, আপনার ফটো না পেলে যে সব বৃথা হবে।

একটু যেন নরম হন বাবা বললেন,“এই ফটো দিয়ে কার কি উপকার হবে?” এমন সুযোগের অপেক্ষায় যেনো ছিলেন ভক্তপ্রবর রাজা মহাশয়। ভক্তিভরে নিবেদন করেন- “বাবা আপনার মতো জীবন্মুক্ত পুরুষের ছবি যে ঘরে থাকবে সে ঘর পবিত্র হয়ে যাবে, এক মহাতীর্থে রূপান্তরিত হবে, গৃহস্বামীর সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হবে। কেবল তাই নয়, এই ফটো বিক্রি করে কতো লোকের জীবিকা নির্বাহ হতে পারবে। আপনি কৃপা করে অল্প সময়ের জন্য একটু বাইরে এসে বসুন, আমরা আমাদের পরম ধনটি সংগ্রহ করে নিয়ে যাই।”

বহু মানুষের মঙ্গল হবে, কল্যাণ হবে, একথা শ্রবণ করা মাত্র ভক্তবৎসল ভগবানের হৃদয় করুণাদ্র হয়, বহুর মঙ্গলের জন্য, বহু পাপী-তাপী সন্তানদের উদ্ধারের জন্য যে তাঁর লোকালয়ে আসা। তাই জীবনের প্রথম এবং শেষ বারের মতো কৃপা করেন ভক্তদের ভগবান, তাঁর একটি মাত্র আলোকচিত্রটি ভক্তদের দান করে। এই তাঁরই মহৎ দান। রাজা বাহাদুর নিমিত্ত, আমরা তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।

অমৃত কথা

“বাসনা হতেই তো দেহ। একটু বাসনা না থাকলে দেহ থাকে না। একবারে নির্বাসনা হলে তো সব ফুরালো।”
- শ্রীশ্রী মা সারদাদেবী

যুগাবতার বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মহান ভক্ত শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাংলা ১২৪৮(১৮৪১ খ্রি.) সনের শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ভোর বেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আনন্দ কিশোর গোস্বামী। তিনি পরম নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁর মাতা স্বর্ণময়ী দেবী ধর্ম নিষ্ঠ দয়াবতী রমণী ছিলেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জন্মদিনে নবদ্বীপের শান্তিপুরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠান প্রতি বৈষ্ণব মন্দিরে হয়ে থাকে।

বিজয়কৃষ্ণের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের পাঠশালাতে। এরপর শান্তিপুরে টোলে সংস্কৃত পড়েন। এখানকার পড়া শেষ করে বিজয়কৃষ্ণ উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। বিজয়কৃষ্ণ ছিলেন ধীর স্থির ও প্রশান্ত। গলায় তুলসীর মালা, মস্তকে শিখা, ললাটে তিলক এবং ধর্মানুষ্ঠানাদিতে তাঁর গভীর অনুরাগ দেখে তার বন্ধুরা বিস্ময় প্রকাশ করতেন। সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময় শিকারপুরের রামচন্দ্র ভাদুড়ীর বড় মেয়ে যোগমায়ার সংগে বিজয়কৃষ্ণের বিয়ে হয়। বিজয়কৃষ্ণ বেদান্ত পড়ছেন। এমন সময় ধর্ম বিশ্বাসে বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল। ভক্তিবাদী গোস্বামী পরিবারের ছেলে হলেও তিনি হয়ে পড়লেন মায়াবাদী। তিনি বেদান্ত দর্শনের একটি ভাষ্য রচনা করে অদ্বৈতবাদ ও মায়াবাদ সমর্থন করেন। সংস্কৃত কলেজে কিছুকাল পড়ার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এই মেডিকেল কলেজে কতগুলি ছাত্রের সংগে একত্র হয়ে হিত সঞ্চারিণী নামে এক সভা স্থাপন করেন। সে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, যিনি যা সত্য বলে বুঝবেন তিনি তা প্রাণপণে কার্জে পরিণত করবেন। এই সভাতে বিজয়কৃষ্ণ বলেছিলেন, “পৈতা জাতি ভেদের চিহ্ন”।

এই কথা শুনে সহপাঠীদের মধ্যে যারা ব্রাহ্মণ ছিলেন তারা সকলে পৈতা ফেলে দিলেন। এই সময়ে ব্রাহ্মণসমাজের সাথে বিজয়কৃষ্ণের যোগাযোগ ঘটে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশব চন্দ্রের বক্তৃতা শুনে তাঁর মনে পূর্বেকার ভক্তিভাব পুনরায় জাগ্রত হয়। তিনি ব্রাহ্মণধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ব্রাহ্মণধর্ম গ্রহন করেন। কিছুকাল পরে বিজয়কৃষ্ণ শান্তিপুরে আসেন। সেখানকার স্থানীয় লোকজন এমনকি আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত, পৈতা ত্যাগ করে ব্রাহ্মণধর্ম গ্রহণের অপরাধে তাঁর প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর বিজয়কৃষ্ণ কলকাতায় চলে আসেন। মেডিক্যালে তাঁর চূড়ান্ত পরীক্ষা সামনে। ব্রাহ্মসমাজ থেকে আহবান আসল ধর্ম প্রচারের কাজের জন্য। চিকিৎসক জীবনের উজ্জল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে বিজয়কৃষ্ণ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি হলেন ব্রাহ্মসমাজের আচার্য বিজয়কৃষ্ণ।

ঢাকা, বরিশাল, যশোর, খুলনা ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ব্রাহ্মসমাজের ধর্মমত প্রচার করেছিলেন। ব্রাহ্মধর্মের দীক্ষা দানও করেছিলেন। এই প্রচার কর্যের এক প্রচারে তিনি কাশীতে যান। সেখানে গঙ্গার মণিকর্ণিকা ঘাটে তৈলঙ্গ স্বামীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি অন্তর্দৃষ্টিতে বিজয়কৃষ্ণের মধ্যে ভক্তিধর্মের উন্মেষ ভাব লক্ষ্য করেন। তিনি বিজয়কৃষ্ণের কানে নামমন্ত্র দিয়ে বললেন, “তোর গুরু নাই সময়ে গুরু লাভ হবে। বসন্তের ঔষধ যেমন বসন্ত, তেমন নামমন্ত্র দিলাম। অন্য কথা কানে লাগবে না।” উত্তরাঞ্চলের অবস্থানকালে একবার বিজয়কৃষ্ণ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এক ভক্ত বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর শরণাপন্ন হন। তিনি অলৌকিকভাবে বিজয়কৃষ্ণকে প্রাণে রক্ষা করেন। বিজয়কৃষ্ণের জীবনে আবার পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও ঠাকুর রামকৃষ্ণের প্রভাবে বিজয়কৃষ্ণ বৈষ্ণব গোস্বামীরূপে পরিণত হন। গয়ার আকাশগঙ্গা পাহাড়ে এসে আকস্মাৎ বিজয়কৃষ্ণের সাক্ষাৎ হয় শক্তিধর যোগীপুরুষ ব্রাহ্মানন্দ স্বামীর সঙ্গে

। তিনি ব্রাহ্মধর্মের আচার্য বিজয়কৃষ্ণকে দীক্ষা দিয়ে হিন্দু যোগীরূপে পরিণত করেন। দীক্ষা গ্রহণের পর আকাশগঙ্গা পাহাড়ে বিজয়কৃষ্ণ আকাধিক্রমে এগার দিন সমাধিমগ্ন হয়ে রইলেন। অবশেষে গুরুর নির্দেশে কাশীতে গেলেন। সেখানে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী শ্রী হরিহরানন্দ সরস্বতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এই সময় বিজয়কৃষ্ণের গার্হস্থ্য আশ্রমে ত্যাগের বাসনা তীব্র হয়। এমন সময় অলৌকিকভাবে গুরু ব্রাম্মানদ সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন, “সংসার ত্যাগের প্রয়োজন নাই। সংসারে অবস্থান করেই তোমার সাধন জীবন অব্যাহত থাকবে।” বিজয়কৃষ্ণ এ সময়ে ব্রাহ্মসমাজ ছাড়লেন। ব্রাহ্মসমাজ ছেড়ে স্ত্রী, পুত্র কন্যা ও শিষ্যদের নিয়ে অর্থ সংকটে পড়লেন।

এই সংকটকালে বারদীর ব্রহ্মচারী লোকনাথ প্রেরনা দিয়ে বললেন, “ঢাকা শহরের নিকটে গণ্ডারিয়াতে নাম, গান, হরিসংকীর্তন কর, তোর অভাব দূর হবে।” ঢাকায় আশ্রম স্থাপন করলেও গোস্বামী মহাশয় মাঝে মাঝে কলকাতায় গিয়ে থাকেন। এবার স্ত্রীসহ বৃন্দাবনে যান। সেখানে বিষুচিকায় তাঁর স্ত্রী দেহ ত্যাগ করে। ১৩০৪ সালের ফাল্গুন মাসে বিজয়কৃষ্ণ কলকাতার লীলা শেষ করে শ্রীচৈতন্যের লীলাভূমি শ্রীক্ষেত্রের পথে যাত্রা করলেন। বিজয়কৃষ্ণের মা একবার ছেলেকে বলেছিলেন, “তুমি যেখানে খুশি সেখানে যাও কিন্তু শ্রীক্ষেত্রে যেও না।” তাঁর ধারণা ছিল পুত্র শ্রীক্ষেত্রে গেলে আর ফিরবে না। বিজয়কৃষ্ণের জননী স্বর্ণময়ী দেবীও ছিলেন একজন সাধিকা। বিজয়কৃষ্ণ সম্বন্ধে তাঁর সতর্কবাণী ব্যর্থ হয়নি। পুত্র শ্রীক্ষেত্র থেকে আর ফিরে আসেনি। শ্রীক্ষেত্রে অবস্থান করার অল্প দিনের মধ্যে পুরী থেকে উড়িষ্যা প্রদেশেও তাঁর প্রভাব ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। শ্রীচৈতনের লীলাভূমিকে বিজয়কৃষ্ণ মধুর হরিনামের মাধ্যমে আরও উজ্জীবিত করে তুললেন।

দলে দলে সাধারণ অসাধারণ সকল শ্রেণির মানুষ বিজয়কৃষ্ণের শিষ্য ও ভক্ত হয়ে পড়লেন।

একদিন এক অপরিচিত বাবাজী বিজয়কৃষ্ণের হাতে দিয়ে গেলেন লাড্ডু প্রসাদ। লাড্ডু ছিল বিষ মিশ্রিত। বিজয়কৃষ্ণের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত কিছু ভক্ত ধর্ম ব্যবসায়ী, তাই এই ষড়যন্ত্র। বিজয়কৃষ্ণ প্রসাদ বলে তা তৎক্ষণাৎ প্রণাম করে খেয়ে ফেললেন।। পর মুহূর্তেই তিনি হয়ে পড়লেন অসুস্থ। গোস্বামীজির চিকিৎসা চলতে লাগল। কিন্তু তাঁর শরীর আর সুস্থ হল না। অবশেষে ১৩০৬ সালের (১৮৯৯ খ্রি.) ২২ শে জ্যৈষ্ঠ রবিবার এই মানব প্রেমিক ধর্মগুরু শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মানবলীলা সংবরণ করেন।

দান-মাহাত্ন্যঃ
“নাম-যশ-খ্যাতির আশায় কেহ রাজকোষের দুর্ভিক্ষ ভাণ্ডারে লক্ষকোটি টাকা দান করলেন, তাতে বহু লোকের জীবন রক্ষা পেল, আবার কোন দরিদ্র ব্যক্তি অনাহারে থেকে নিজের জন্য প্রস্তুত অন্ন বুভুক্ষু অতিথির সেবায় দিলেন, তাতে মাত্র একজনের উপকার হলো। কোন দান শ্রেষ্ঠ? নৈতিক বিচারে দরিদ্রের দান শ্রেষ্ঠ, কেন না এ স্থলে দরিদ্র কর্তার বুদ্ধি পবিত্র ও নিষ্কাম; ধনী কর্তার বুদ্ধি কামনা ও ফলাকাঙ্খা প্রসূত।”

অমৃত কথা

“সংসার বদ্ধ আছে জিহ্বা আর উপস্থে, যে এই দুটির সংযম করতে পেরেছে, সে-ই সিদ্ধিলাভ করতে পারে।”
--শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

সমদর্শী বাবা লোকনাথ

বাবা লোকনাথ ছিলেন সমদর্শী। তিনি শুধু বর্ণ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষকে সমানভাবে দেখতেন না বা সমভাবে ভালোবাসতেন না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ সর্বজীবকে সমভাবে দেখতেন। সমদর্শনের মূর্তবিগ্রহ জীবন্ত উদাহরণ, বাবা লোকনাথের লীলায় তাই আমরা দেখতে পাই তাঁর আশ্রমে একটি পিপীলিকা থেকে ধনী ভক্ত সবার সমান অধিকার। কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়। এই কেবল তাঁর বাণী নয় দর্শন নয়; দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কর্মের মধ্য দিয়েই তিনি এই অভেদ দর্শনের ভাবটি রেখেছেন সর্বাগ্রে লোকশিক্ষার জন্য।

তিনি দাতা। তাঁর আশ্রমে আগত বা শরণাগত ভক্ত মাত্রেই সব চাওয়াই তিনি পূর্ণ করেছেন, অকাতরে দান করে। ক্ষুধার্তকে অন্ন দিয়ে, নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়ে, উৎকট ব্যাধিগ্রস্থ মৃতপ্রায় রোগীকে প্রান দিয়ে তিনি কৃতার্থ করেছেন। ব্রাহ্মজ্ঞানের পিপাসু সাধককে তিনি দিয়েছেন জ্ঞান। ভক্তের ভক্তিকে তাঁর কৃপায় করেছেন সিঞ্চিত অগনিত শরণাগতকে কর্মমার্গে পরিচালিত করে। তাদের জীবনে দিয়েছেন বহু বাঞ্ছিত শান্তি এবং দিব্য আনন্দ। বাইরের শুষ্ক আবরণের ভেতরে ফল্কুধারার মতন প্রবাহিত তাঁর দয়া এবং মমতাময়ী মাতৃ সরূপটি। সন্তানের এতটুকু কষ্টও সেই মাতৃ হৃদয়ে সহ্য হয় না।

বাবা লোকনাথের সমদর্শনের কয়েকটি উদাহরনঃ কালীচরণ পোদ্দার ধনীর সন্তান, ব্যাধিতে কষ্ট পাচ্ছে সে, ভাবে একবার বাবার দর্শন করলে যদি ব্যাধি মুক্ত হয়। সঙ্গে এক আর্দালী নিয়ে সে বারদীর আশ্রমে পৌঁছায়। সের পাঁচেক দুধ সঙ্গে এনেছে,

ভজলেরাম দুধটি বাবার ঘরের সামনের বারান্দায় রাখতেই বাবা বলে উঠলেন, “না না ও রাখা যাবে না।” সচকিত হয়ে ওঠে ভজলেরাম, বুঝতে অসুবিধা হয় না নিশ্চয়ই অন্তর্যামী প্রভুর মনঃপুত হইনি, তাই তাড়াতাড়ি নামিয়ে রাখে সে বারান্দার নিচে। কালীচরণও বাবার এই ধরনের ব্যবহারে বেশ ভীত হয়ে ওঠে। করজোড়ে বিনিত নিবেদন করে, বাবা যেন তার দেওয়া দুধ গ্রহণ করেন। বাবার মধ্যে কোনো ভাবের পরিবর্তন দেখা যায় না। বেশ কঠিনভাবেই তিনি বললেন, “তুই ধনীর ছেলে, যদি একটা পাত্রসহ দুধ দিতে পারিস তো নিতে পারি।”

মহাপুরুষের এই রহস্যময় উক্তির অর্থ বঝে না কালীচরণ, তাই একটি মাটির হাঁড়ি কিনে এনে তাতেই দুধ ঢেলে আবার বারান্দায় রাখতে যায় সে; কিন্তু কুতিরের ভিতর থেকে আবার গম্ভীর কণ্ঠে শোনা যায় সে আদেশ- “না না ও না করে ভজলেরাম দুধের পাত্রটি নিচে নামিয়ে রাখে।

এই সময় আশ্রমের একটি কুকুর এসে মহানন্দে দুধের পাত্র থেকে দুধ খেতে শুরু করে দেয়, আশ্রমবাসীরা কেউই কিন্তু কুকুরটিকে বাধা দেয় না, বাবার ভাব তাদের অজানা নয়। কালীচরণ কিন্তু সহ্য করতে পারে না এই দৃশ। তার দেওয়া দান, বাবার ভোগে না লেগে একটি কুকুরের ভোগে এভাবে নষ্ট হতে দেখে সে শশব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে এবং কুকুরটিকে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়।

বাবা লোকনাথ শাসনের সুরে বলেন, “তোর ভাব আজনি বলেই তো তোর দুধ আমি গ্রহণ করিনি। তুই দুধ আমাকে দিয়েছিস, সুতরাং ঐ দুধের উপর তোর যে স্বত্ব ছিল তা আর নেই, তবে তোকে আশ্রমের কুকুরকে ঐ দুধ খেতে না দিয়ে তাড়িয়ে দেবার অধিকার কে দিল?”

এই ছিত ঘটনাটির মধ্য দিয়েই বাবা অর্পণতত্ত্ব শিক্ষা দিলেন তাঁর সন্তানদের। জীবন্নুক্ত মহাপুরুষের সমদৃষ্টিতে কোন ভেদের স্থান নেই। সর্বজীবের এক পরম অস্তিত্বকে সদাই তিনি দর্শন করেছেন, তাই স্বাভাবিকভাবে তাঁর সবার প্রতি সমান ভাব। বাবা বললেন, “দুধ যখন একবার আমাকে দান করেছিস তখন দুধের উপর তোর আর কোনো সত্ত্বই নেই।” বাবার এই উক্তি গভীর অর্থপূর্ণ।

ঈশ্বরের উদ্দেশে কিছু অর্পণ করাও এক সাধনা। কেবল অনেক অর্থ কিংবা অনেক সামগ্রী প্রভুকে দান করলেই প্রভু প্রসন্ন হন না। ভাবগ্রাহী মধুসূদন কেবল ভাবটুকু দর্শন করেন। কে কি ভাব নিয়ে তাঁর চরণে অর্পণ করেছে এটুকু তাঁর দৃষ্টিতে বড়। মনের উদারতা এবং নিস্কপটতার উপর তার কঠিন দৃষ্টি।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দানের সঙ্গে দাতার অহংকার যুক্ত হয়ে দানের মহিমাকে খর্ব করে তোলে। আরও একটি ভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, সাধু মহাত্মাকে সাধারণ গৃহী ভক্তরা যখনি কোনো কিছু দান করেন, তখন মনের মধ্যে এ ভাবটি প্রছন্ন থাকে যে, অর্পিত বস্তুটি যেন মহাপুরুষ নিজে ব্যবহার করেন। এর অন্যথা হলে তারা মনে মনে ক্ষুণ্ণ হন। বাবার এই লীলার মূল উদ্দেশটি হলো ভক্তকে এই শিক্ষা দেওয়া যে, দানের সঙ্গে কোনো নিজস্ব সত্ত্ব বা ইচ্ছাকে জুড়ে দেওয়া উচিত নয়, তাতে ভগবান অপ্রসন্ন হন। পবিত্রতা এবং ভক্তির ভাব নিয়ে পরম প্রভুকে যাই দেওয়া হোক না কেনো তা তিনি অতি আনন্দ সহকারে গ্রহণ করেন।

ভগবানকে কিছু দেওয়ার সময় ভক্তের মনে কেবল প্রভু প্রসন্নতাই একমাত্র প্রাণিধানের বিষয়। নিঃস্বার্থভাবে দান করতে পারলে মনোজগতে আধ্যাত্মিক রুপান্তরণের পথকে

সুগম করে। দানের বস্তুটি নিয়ে, যিনি দান গ্রহণ করলেন, তিনি কি করলেন সেটা দাতার বিবেচনার বিষয় কখনই হওয়া উচিত নয়। কালীচরণ বাবাকে দুধ দেওয়ার মধ্যে শ্রদ্ধার অভাবের সঙ্গে সঙ্গেই অন্তর্যামী প্রভু ঐ শর্ত রেখে দানের ভাবটি লক্ষ্য করছিলেন বলেই তিনি প্রথম হতেই ঐ দান গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।

বাবা সতর্ক করেছেন তাঁর শরণাগতকে দান কর; কিন্তু দাতার অহংকারকে পরিত্যাগ কর। এই পবিত্র দানের ভাব দাতার কাছে প্রভুর কৃপাকে আকর্ষণ করে আনে এবং তাকে কেবল জাগতিক ভোগ্যবস্তু প্রদান করে না, সেই সঙ্গে আধ্যাত্মিক জাগরণের পথকে সহজ করে তোলে।

যিনি ঈশর তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ। কোনো অভাববোধই তাতে নেই। ব্রাহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ ক্ষুদ্র অহংশূন্য মহাচৈতন্য নিত্য রমণ করেছেন, তাই পরিবর্তনশীল জাগতিক কোনো বস্তুর আকাঙ্ক্ষাই তাঁর মধ্যে নেই। তবুও তাঁকে আমরা ভক্তের কাছে হাত পেতে কিছু চাইতে দেখি। ভক্ত হাত তুলে কিছু দিলে তাকে ছোট শিশুর মতন মহানন্দে অতিভূত হতে দেখি এই লীলা প্রভু করেন কেবল ভক্তের ঝুলিটি একটু শূন্য করার জন্য, ঐ শূন্য স্থানেই তিনি তাঁর কৃপাবারি বর্ষণ করেন। নেন কেবল দেওয়ার জন্য। না দিলে যে পাওয়া যায় না। পেতে গেলে দিতে হয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তকে বলেছেন, “আমাকে একটু প্রানের ছোঁয়া দিয়ে আন্তরিকভাবে পত্র, পুস্প, ফল,জল যা দেবে, আমি তাই গ্রহণ করব।”

জাগতিক জীবনেও আমরা দেখি পরিচিত জন আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের কিছু হাতে তুলে দিলে, তাতে আমাদের মনে কতো আনন্দ হয়। সন্তান মাকে একটু ভালবাসলে, মাকে কিছু দিলে মায়ের মনে যে আনন্দ, যে তৃপ্তি বোধ, তা মাতৃহৃদয়েই অনুভব সম্ভব। তেমনি ভগবান, গুরু, তিনি যে আমাদের বড় আপনজন, প্রাণের প্রাণ, তাঁর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন না হলে যে ভক্তিও পাকা হয় না। তাঁকে আপনজন জ্ঞান করে আমাদের সবকিছুর মধ্যে তাঁকে তাঁর প্রসাদ পাওয়ার সাধনা করলে তিনি অত্যন্ত প্রসন্ন হবেন, এতো সহজ অনুমানযোগ্য।

তাঁকে কিছু দিয়ে আমরা তাঁকে ধন্য করি না, নিজেরাই ধন্য হই। বাবার বারদীর আশ্রম ছিল এক আদর্শ আশ্রম। সেখানে পশুপাখি, কীটপতঙ্গ থেকে মানুষ দেবতা সবার সমান অধিকার। সবাই বাবার কৃপা আশ্রিত। তাই আমরা দেখতে পাই ভক্তের দেওয়া এক ঝুড়ি ফল যখন কালাচাঁদ নামক বাবার অতিপ্রিয় বৃষটি মহানন্দে খেতে শুরু করেছে; আর তাই দেখে রজনী ব্রহ্মচারী যখন তার মুখ থেকে ফলের ঝুড়িটি সরিয়ে নিতে যাচ্ছে, বাবা শাসনের ভাব নিয়ে বলেছেন,

-“ওর গ্রাসেরটা তুই নিচ্ছিস কেন রে?”

আদুরী বাবার বড় আদরের বিড়াল। একবার আদুরী প্রসব বেদনায় খুব কষ্ট পাচ্ছে, ঐ অবস্থায় সে ছুটোছুটি করছে একটু গোপন এবং সুরক্ষিত স্থানের জন্য। করুণাময় বাবার দৃষ্টি পড়ে তার উপর, তাকে কাছে টানে, পরম স্নেহভরে কোলের মধ্যে উঠিয়ে নেন তিনি এবং আদুরীও জগতের সব থেকে সুরক্ষিত স্থানটি পেয়ে নিশ্চিত হয়েই প্রসব করে। নিজের অঙ্গের কৌপিন এবং বালাপোষ দিয়ে ধাত্রীর কার্জ সম্পন্ন করেন। বাবা এমন করুণার লীলা অন্তরে ধ্যান মাত্রেই ভক্তের হৃদয়ে নিয়ে আসে বিস্তর- সব সঙ্কোচন থেকে মুক্তির আশ্বাস।

আশ্রমের পিপীলিকারাও বাবার বিশেষ কৃপাভাজন। বাবার পরিবারের জন। তাই প্রায়ই চিনি কিংবা মিশ্রের দানা ছড়িয়ে তাদের ডাকেন তিনি। যতক্ষণ না তারা সব কটি দানা নিয়ে তাদের বাসস্থানে চলে যায় ততক্ষণে তাদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন তিনি। একদিন আশ্রমে এক বিশিষ্ট ভক্ত আসেছেন, কিন্তু এমন অসময়ে বাবার কুটিরের দ্বার রুদ্ধ কেন? এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর কোনো আশ্রমবাসীই দিতে পারে না। অন্তর্যামী ভগবান ভক্তের আগমন জানতে পেরে ভেতর থেকে বলে ওঠেন, “ওরে এখন ভেতরে আসিস না, আমার পরিবার আছে।”

ভক্তটি কৌতূহল দমন করতে না পেরে উঁকি মেরে বাবার ঘরের ভিতরে দেখতে চেষ্টা করেন কিন্তু একমাত্র আসনে উপবিষ্ট বাবাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যান বাবার কথার অর্থ চিন্তা করে। ইতিমধ্যে বাবা কুটিরের ভিতরে প্রবেশের জন্য আহ্বান করেন। ভক্তটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই কিন্তু তার সংশয় দূর হয়। বহুসংখ্যক পিপীলিকার এক লম্বা লাইন তখন বীরবিক্রমে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের মুখে চিনির দানা। বুঝতে পারে সে বাবার আদেশের মর্মার্থ, ঐ সময় ঘরে প্রবেশ করলে অসাবধানতার ফলে হয়ত পদদলিত হয়ে অনেক পিপীলিকার প্রাণ যেতো, তাই দয়াময় ভগবান বলেছেন- “ভেতরে আসিস না, আমার পরিবার আছে।”

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, আগত ভক্ত বারদীর জমিদার শ্রীঅরুণকান্ত নাগ মহাসয়। বলতে দ্বিধা নেই যে , আজকালকার আশ্রমে মাঠে সাধু বাবারা ধনীশেঠ এবং মন্ত্রীদের আগমনে নিজেদের বিশেষ ধন্য মনে করেন এবং তাদের সেবা এবং সম্মান প্রদর্শনের জন্য সাধারণের থেকে সর্বদা আলাদা ব্যবস্থাই করে থাকেন। কিন্তু সমদৃষ্টির মূর্তবিগ্রত বাবা লোকনাথ কেবল গৃহীদের সর্বজীবে দয়া এবং প্রেম শিক্ষা দিলেন না, সেই সঙ্গে সাধুদের সমদর্শনের আদর্শ শিক্ষা দিচ্ছেন। তাঁর

উদার করুণা পিপীলিকার স্থান জমিদারের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়, তা জমিদারকেও কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। ইতর প্রাণীর প্রতি বাবা লোকনাথের অসীম করুণার একটি সুন্দর লীলা কাহিনীর কথা আমরা শুনি-

একবার একটি ব্যাধিগ্রস্থ কুকুর অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বাবার কুটিরের পাশে আশ্রয় নেয়। আশ্রমমাতা গোয়ালিনী মায়ের চোখে পড়ে এই দৃশ্য, লোকনাথের সান্নিধ্যে থেকে তাঁর মধ্যেও জেগেছে সর্বজীবে দয়ার ভাব। কুকুরটির ব্যথায় ছটফট করতে দেখে মাতৃহৃদয় ব্যথিত হয়, ছুটে যান, তিনি বাবার কাছে, নিবেদন করেন অন্তরের ব্যাকুল প্রার্থনা- “তোমার কৃপায় কতো লোকই কতো দুঃসহ যন্ত্রণা এবং দুরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকে রেহাই পেলো, এই আশ্রমে আগত কোন শরণাগতকেই তো তুমি তোমার কৃপার ছায়া বঞ্চিত করনি, তবে এই কুকুরটির প্রতি তোমার কৃপা দৃষ্টি কেন হবে না?”

গোয়ালিনী মায়ের মধ্যেও সমদর্শন ও জীবে দয়ার ভাব লক্ষ্য করে মঙ্গলময় বাবা লোকনাথ অত্যন্ত প্রসন্ন হন। শরণাগত ভক্তকে এভাবেই তিনি সূক্ষ্মভাবে অন্তর্জগতে কৃপাস্পর্শের মাধ্যমে কতো পরিবর্তন সংঘটন করে, ভক্ত বোঝেও না। মায়ের কথাটুকু শোনামাত্র বাবার হৃদয় দয়ার্দ্র হয়, তিনি তাঁর আসন ছেড়ে তৎক্ষণাৎ উঠে আসেন, মায়ের সঙ্গে মুমূর্ষ কুকুরটির কাছে যান, চলৎশক্তি রহিত অবস্থায় কুকুরটির ভ্রুযুগলের কেন্দ্রস্থলে স্পর্শ করেন, মুহূর্তের মধ্যে কুকুরটির সব যন্ত্রণার অবসান হয়, বাবার কৃপায় নবজন্ম হয় তার।

অমৃত কথা

“জগতের ব্রহ্ম ছাড়া কোন বস্তু নাই… তাঁরই শক্তি সব দেবদেবীতে বিরাজিত। তিনিই পুরুষ তিনিই প্রকৃতি।” --শ্রীশ্রী মা সারদাদেবী

পূর্ণ পুরুষ লোকনাথ

মহাযোগীবাবালোকনাথকেপূর্ণপুরুষবলাহয়।কারনতাহাঁরমধ্যেসবাইইতিবাচক, নেতিবাচককিছুনেই ( In him everything is positive and nothing negative ) ।কুমিল্লাখুনেরমামলারআসামীনিবারনরায়েরউপরবাবালোকনাথেরকরুণারকথাআজওঅবিস্মরণীয়হয়েআসে।

খুনেরআসামীনিবারনরায়েরফাঁসিরহুকুমহয়েছে।কলকাতাহাইকোর্টে আপীল করা হয়েছে । শুনানির দিন বন্ধ কারাগারের দুয়ারের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যুর কালো ছায়াকে ঘনীভূত হতে দেখে নিবারণ রায় ধৈর্যহারা হয়ে উন্মাত্তের মতোন পদচারণ করেছেন । কে তাকে বাচাতে পারে এই চিন্তাই তার সর্বসত্তা অধিকার করে গেছে । এ সময় তার অন্তরে কে যেনো বলে , “ লোকনাথ স্মরণই উপায় ” মহাপুরুষের নাম তিনি শ্রবন করেছেন কিন্তু দেখার তার সৌভাগ্য হয়নি । জীবনের সবচেয়ে সংকটের মুহূর্তে আজ এই নামই যেনো তার কাছে সংকট মোচনের একমাত্র মহামন্ত্র বলে মনে হয় । অন্তরের সবটুকু আর্তি সবতস্ফুর্তভাবেই প্রকাশ পায় । অন্যন শরণ হয়ে তিনি ‘ লোকনাথ ’ মহানাম স্মরন করতে থাকেন ।

মুহূর্তের মধ্যে কৃপায় মূর্তবিগ্রহ কায়া গ্রহন করে এগিয়ে আসেন । পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে নিবারণ রায় দেখেন যে , এক জুটাজুটমণ্ডিত শিবকল্প যোগী অবলীলায় কারাগৃহের লোহার ফটকের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে তারই দিকে এগিয়ে আসছেন । মহাপুরুষের পরিচয় জানতে চান নিবারণ রায় । কিন্তু সে কথার জবাব না দিয়ে শরনাগতির ফলটুকু দেন , মহাযোগী বলেন, “আমি তোর মোকদ্দমার রায় লিখে নিয়ে এসেছি, তুই খালাস হয়েছিস । ”

কারা কঠোর শিকলাবদ্ধ দুয়ারের মধ্য দিয়ে যেমন এসেছিলেন, তেমনি বেরিয়ে যান তিনি, কেবল বলে যান, “ওরে আমার বিনাশ নাইরে, আমি বারদীর ব্রহ্মচারী । ” পরের দিন টেলিগ্রামে আসে নিবারনের খালাসের রায় নিয়ে । প্রান ফিরে পেয়ে ছুটে যান তিনি বারদীর আশ্রমে । বাবার তৈলচিত্রেটি দেখেই আত্নহারা হন, বলে ওঠেন “এই সেই মহাপুরুষ, ইনিই আমাকে কারাগারে কৃপা করেছিলেন । ” বাবা খেদের সুরে কতোবার এই উক্তি করেছেন, “আমাকে তোরা শরীর ভেবেই গেলি আমি যে কে, টা জানিবার চেষ্টা কেউ করলি না । ” “তোদের যে বোঝাবো তাও তো পারি না নিজের সেই সত্তার কথা বলা কওয়া যায় না । ”

বারদী নিবাসী ডেঙ্গু কর্মকার, এক ফৌজদারী মামালায় স্থানীয় বিচারকের বিচারাধীন কুমিল্লা দাউদকান্দিতেই অবস্থান করেছে । মোকদ্দমার অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে । তাই ডেঙ্গু নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়েই ছুটে বেড়াচ্ছে এক উকিল থেকে আর এক উকিলের কাছে, অসহায় অবস্থা দেখে তার এই দুরবস্থার সুযোগ অনেকেই নিতে ছাড়ছে না ।

সে আজ জীবনের এক সংকটময় অবস্থার সম্মুখীন । দুই এক দিনের মধ্যেই রায় বেরোবে তাতে নিশ্চিত সে দোষী প্রমান হবে এবং ফাঁসি হবে । উদ্ভ্রান্ত হয়ে গ্রামের পথ ধরে চলেছে সে এমন সময় তার চোখ পড়ে এক অসাধারণ মনুষ্য মূর্তি এক বৃক্ষের তলায় উপবিষ্ট । তার দিকে যেন তাকিয়ে আছেন । চোখ দুটি আকর্ণ বিস্তৃত পলকহীন, দীর্ঘ জটাজুটমণ্ডিত এই দেহ যেনো এই পার্থিব জগতের নয় । ডেঙ্গু মুহূর্তের মধ্যে খোঁজে পায় , যাকে সে নিজের অজান্তে জন্মে জন্মে খুঁজে বেড়াচ্ছে কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো এই চোখ দুটি তাকে আকর্ষণ করেছে, মন থেকে কে যেনো বলছে, “ তুই পেয়ে গেছিস, আর তোর কোন চিন্তা নেই ।

কেবল নিজেকে অর্পণ করলেই আর তোর ভার তাকে বইতে হবে না, সন দায়িত্ব তার । ” ডেঙ্গু সে সন্ন্যাসীর চরণাশ্রয়ে চরণ দুটির মধ্যে মাথা রেখে অসহায় শিশুর মতো কাঁদতে থাকে, তুমি আমাকেও বাঁচাও, আমি আর দুঃসহ জ্বালা সহ্য করতে পারছি না । শরনাগতকে রক্ষার জন্যই তো তার আবির্ভাব ।

মধু কণ্ঠে অভয় বাণী উচ্চারিত হয়, তোর কোন চিন্তা নেই – আমার নিজের হস্তে রায় নিয়ে এসেছি তুই বেকসুর খালাস হবি । সত্য সত্যই রায়ের দিন ডেঙ্গু ফাঁসির হুকুম হতে খালাস পেল, ডেঙ্গুর আনন্দ দেখে কে ।

বাবা লোকনাথের এই দুইটি ঘটনা সত্য সত্যই প্রমাণিত হলো বাবার মধ্যে সবাই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছুই নয় । বাবা যে পূর্ণপুরুষ, মানবরূপে ভগবান তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।

অমৃত কথা

“ মা, মাতৃদুগ্ধ, মাতৃস্নেহ, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি – এর বিকল্প হয় না । ”

লোকনাথ সর্বশক্তিমান

ভগবান যুগে যুগে আসেন মানবরূপে মানুষের কল্যানের জন্য । লোকনাথ কেবল ত্যাগী , তপস্বী, যোগী নন । তিনি সর্বশক্তিমান আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ সমাজ সংস্কারক শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, সর্বজীবনের জনক । তাঁর সন্তানের জন্য যা কিছু অকল্যাণকর তাও তিনি দেখেন,সর্বশক্তি দিয়ে দূর করেণ । তারই কয়েকটি উদাহরণ । আশ্রমে বাবা লোকনাথ বসে আছেন । চোখে পড়ে লালশাড়ি পরিহিতা এক নারী তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন । এই নারী যে কোন অসাধারণ নারী নয় । তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না বাবা লোকনাথের । বোঝলেন শীতলা দেবী এসেছেন । বাবার সঙ্গে দেখা দৃষ্টি বিনিময় হতেই শীতলা দেবি বলেন, “ আমি এখান দিয়ে যাবই । ” কথাগুলোর মধ্যে নিজের ইচ্ছা এবং মহাপুরুষের অনুমতির জন্য প্রার্থনা দুই – ই ব্যক্ত হয় । অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বাবা আদেশ করেন , “না এখান দিয়ে যেতে পারবে না । ” বেশ কিছু সময় নির্বাক হয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে শেষে শীতলা দেবী এক পা সামনে অগ্রসর হবার চেষ্টা করেন । ক্রোধান্বিত হন বাবা । বলেন, “আমি এখানে আছি । ” – এই যেনো অলঙ্ঘনীয় আদেশ । ভয় পেয়ে নিজের জায়গা ফিরিয়ে নেন তার পা, বলেন, “তবে কি এখানেই আবদ্ধ থাকতে হবে । আমি কি যাওয়ার পথ পাব না ? ”

বাবা লোকনাথ বলেন “না এখানে আবদ্ধ থাকতে হবে না, তবে উচ্চভূমির উপর দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে না । ছাওয়ালবাঘিনী নদীর ঢালুভূমি দিয়ে চলে যাও । ”

আশ্রমের চারিদিকে ঘনবসতি একমাত্র ছাওয়ালবাঘিনী তীরে ঢালু ভূমিতে কয়েক ঘর মানুষ বসবাস করে । তাই এক রকম নিরুপায় হয়ে ঐ পথটি বেছে নেন ।

কয়েকদিনের মধ্যেই ঐ স্থানের বাসিন্দাদের মধ্যে কিছু লোক বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয় এবং তারা বাবার শরনাগতি নিলে বাবা তাদের ঐ স্থান ত্যাগ পূর্বক প্রান বাঁচাতে নির্দেশ দেন । বাবা লোকনাথের বারদী আগমননের পূর্বে বহুলোকের বসন্ত রোগে মারা গেছে । কিন্তু বাবার আগমনের পর হতে আর কোনোদিন বারদীতে বসন্ত রোগে কোনো লোক মৃত্যুবরন করেনি । দেবদেবীর যে বাবা লোকনাথের আদেশ মানেন এখানেই তাই প্রমাণিত হলো । এটা উল্লেখযোগ্য যে, প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাবা লোকনাথকে প্রথম দিন দর্শন করলেন – তখন তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখলেন বাবার দেহে সর্ব দেবদেবী বিরাজমান ।

বারদীর ধনাঢ্য সম্মানিত নাগ চৌধুরীর সদস্য উমাপ্রসন্ন নাগ চৌধুরী এক সংকটে পড়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী এক্তি শিশুপুত্রের জম্ন দিয়ে জগৎ ছেড়ে চলে গেলেন । কিন্তু সন্তানকে বাঁচাতে গেলে মাতৃদুগ্ধ যে অনিবার্য । অনেক চিন্তা করে স্থির করলেন এক দুগ্ধবতী ধাত্রীকেই এই কাজের জন্য নিয়োগ করবেন । সেই সময়ে তারই ভগিনী সিন্ধুবাসিনী ঘরে ছিলেন । কিন্তু তিনি যে বন্ধ্যা । অন্তরে মা হবার সাধ তাঁর চিরকালেরই । কিন্তু ভাগ্যের এমনই বিধান যে কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছা কোনোদিন পূরণ হয়নি । ঘরে এমন সুলক্ষন যুক্ত সন্তানকে এমন সংকট সময়ে দেখে তাঁর ব্যথা হয় । তিনি স্থির করলেন একবার বারদীর লোকনাথ বাবার শরনাগতি নিয়ে বাবা লোকনাথের কাছে নিবেদন করবেন । তাঁর অন্তরের আর্জি সিন্ধুবাসিনীর মুখের কথা বাবা খুব ধৈর্য ধরে শোনেন । একবার তাঁর চরণে সব পৌঁছে গেলে কৃপা হতে তাঁর বেশি দেরী হয় না । সিন্ধুবাসিনী দেবীর জীবনে আজ এক শুভ মুহূর্ত আগত । তাই বাবা বলেন শিশুর লালন পালনের জন্য ধাত্রীর প্রয়োজন নাই । তাই আমার কাছে এসে বস, আমি তোর স্তন্য পান করব । বন্ধ্যা সিন্ধুবাসিনীর শরীরে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় । তাঁর স্বপ্ন যে ভগবান স্বয়ং এভাবে পূরণ করবেন ।

এ যেন তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না । স্বয়ং ভগবান তাঁর দুগ্ধ পান করবেন । এমন সৌভাগ্য তাঁর আনন্দে বিহবল হয়ে তিনি বাবার চরণের কাছে আসলেন ।

বাবা লোকনাথ ছোট শিশুর মতই সিন্ধুবাসিনী স্তনে মুখ দিয়ে দুগ্ধ পান করলেন । তাঁর দিব্যশক্তির প্রভাবে বন্ধ্যা রমণীর দুগ্ধের বন্যা বয়ে যায় । সিঞ্চিত হয় তাঁর পরনের বস্ত্র । আজ তিনি মা । শিশুর প্রান রক্ষা করার উপায় ভিক্ষা চাইতে এসে তিনি লাভ করলেন তাঁর বহু বাঞ্চিত মাতৃ্ত্ব । বাবার অপার করুণায় ধন্য হন তিনি । এই শিশুটি ব্রাহ্মাস্বরূপ লক্ষন বাবা লোকনাথের কৃপাধন্য । উপাপ্রসন্ন নাম রাখলেন, ব্রহ্মাপ্রসন্ন নাগ উত্তর কালে এই সন্তান বাবা লোকনাথের একনিষ্ঠ ভক্তরুপে সমাজে পরিচিতি লাভ করেন, কৃপা লাভ করে সাধন জগতে উন্নতি লাভ করেন । তাঁর প্রতিষ্ঠিত লোকনাথ আশ্রম (পশ্চিমবঙ্গে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত ) দক্ষিন কলকাতার গড়িয়ায় অবস্থিত । আজও বাবা লোকনাথের নিত্যসেবা করে সমাজে লোকনাথ ভক্তির বীজ বপন করে চলেছে । অন্তর্যামী লোকনাথ বিভূতির মধ্য দিয়ে তাঁর আশ্রিত ভক্তজনকে তার অপরূপ শিক্ষা দিতেন । দুই ঘটনা হতে বাবা লোকনাথ যে সর্বশক্তিমান ভক্ত সমাজে তা প্রমাণিত হলো ।

শ্রীমৎ ব্রহ্মানন্দ ভারতী

লৌকিক নাম ঃ শ্রী তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ।
পিতা ঃ উমাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ।
বাংলাদেশের তদানিন্তন ঢাকা জেলার বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর মধ্যপারায় ১২৫৯ সন ৬ই অগ্রহায়ন জন্মগ্রহন করেন । পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ ছিলেন । ঢাকা নর্মাল স্কুলে বিদ্যাশিক্ষা শেষ করে পরবর্তীতে ওকালতি পরীক্ষায় কৃতকার্য হন । ঢাকা নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জ মহকুমায়, বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার মুন্সেফ কোর্টে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন । ব্যবসায়ে বেশ খ্যাতি প্রতিপত্তি বৃদ্ধি হয়েছিল । কিন্তু হঠাৎ পূর্ব সংস্কারের প্রেরণায় বশীভূত হয়ে অর্থকরী ব্যবসা পরিত্যাগ করেন । বারদীধামে এসে জগসিদ্ধ শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার শরণে নিজেকে সমর্পণ করেন । তাঁর তিনপুত্র ও দুই কন্যা পৌত্র পৌত্রী ইত্যাদি ছিল । লৌকিক জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি কাশীধামে ছিলেন এবং সেখানে ১৩৩৩ সনে ৬ ই আষাঢ় সোমবার সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেন ।

তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী :
১. আভিজাত্যমূলক কৌলিন্য সংস্কার
২. সন্ধ্যাযোগ রহস্য
৩. সিদ্ধজীবনী

অমৃত কথা

“মানুষের মৃত্যুতে ব্যথিত হইনি, ব্যথিত হয়েছি মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে ”
- স্বামী পরমানন্দ

ধর্ম ও সংসার

সংসারে ডুবে থেকে যে ঈশ্বরকে ডাকে সে বীর ভক্ত । ভগবান বলেন, যে সংসার ছেড়ে দিয়েছে সে তো আমায় ডাকবেই, আমার সেবা করবেই তার আর বাহাদুরি কি ? সে যদি আমায় না ডাকে সকলে ছি ছি করবেই । আর সে সংসারে থেকে আমাকে ডাকে বিশমন পাথর ঠেলে যে আমায় দেখে সেই-ই বাহাদুর, সেই বীরপুরুষ । তাঁকে যদি লাভ করতে পারো,সংসার আসর বলে বোধ হবে না। যে তাঁকে জেনেছে , সে দেখে যে জীব জগত তিনিই হয়েছেন । ছেলেদের খাওয়াবে যেন গোপালকে খাওয়াচ্ছো । পিতা-মাতাকে ঈশ্বর-ঈশ্বরী দেখবে ও সেবা করবে । তাঁকে জেনে সংসার করলে বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে দৈহিক সম্বন্ধ থাকে না । লুকোচুরি খেলায় যেমন বুড়ি ছুঁলে চোর হয় না , সেই রকম ভগবানের পাদপদ্ম ছুঁলে চোর হয় না, যে বুড়ি ছুয়েছে, তাঁকে আএ চোর করবার জো নেই । সংসারে সেই রকম যিনি ঈশ্বরকে আশ্রয় করেছেন, তাঁকে তাঁর কোনো বিষয়ে আবদ্ধ করতে পারে না । অদেশে ছুঁতোরদের মেয়েরা চিড়ে বেচে । তারা কতো দিক সামলে কাজ করে শোন । ঢেঁকির পাট পড়ছে, আবার ধানগুলি হাত দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে, এক হাতে ছেলেকে মাই দিচ্ছে । আবার খদ্দরকে বলছে, তাহলে তুমি যে ক পয়সা ধার আছে, সে ক পয়সা দিয়ে যেও , আর জিনিষ লয়ে যাও । দেখ ছেলে মাই দেওয়া, ঢেঁকি পড়ছে, ধান ঠেলে দেওয়া ও কাঁড়া ধান তোলা, আবার খদ্দরের সঙ্গে কথা বলা, এক সঙ্গে করছে । এরই নাম অভ্যাসযোগ্য । কিন্তু পনর আনা মন ঢেঁকির পাটের দিকে রয়েছে, পাছে হাতে পড়ে যায় । আর এক আনায় ছেলেকে মাই দেওয়া আর খদ্দরের সঙ্গে কথা কওয়া । তেমনি যারা সংসারে আছে, তাদের পনর আনা মন ভগবানে দেওয়া উচিৎ । না দিলে সর্বনাশা কালের হাতে পড়তে হবে । আর এক আনায় অন্যান্য কর্ম কর ।

জলে নৌকা থাকে ক্ষতি নেই, কিন্তু নৌকার ভেতর যেন জল না ঢোকে, তাহলে ডুবে যাবে । সাধক সংসারে থাকুক ক্ষতি নেই, কিন্তু সাধকের মনের ভেতর যেন সংসারভাব না থাকে । নির্লিপ্তভাবে সংসার করা কি রকম জান ? পাঁকাল মাছের মতন । পাঁকাল মাছ যেমন পাঁকালের মধ্যে থাকে কিন্তু তাঁর গায়ে পাঁক লাগে না । বাউল যেমন দু হাতে দুরকম বাজায় ও মুখে গান করে, হে সংসার জীব । তোমরাও তেমনি হাতে সমস্ত কাজকর্ম কর কিন্তু মুখে সর্বদা ঈশ্বরের নাম জপ করতে ভুলো না । সংসার ধর্ম তাতে দোষ না, যদি কারু পিঠে একটা ফোঁড়া হয়, সে যেমন সকলের সঙ্গে কথাবার্তা কয়, হয়তো কাজকর্মও করে কিন্তু যেমন ফোঁড়ার দিকে মন পড়ে থাকে, সেই সঙ্গে সংসার কেমন? যেমন আমড়া-শাঁসের সঙ্গে খোঁজ নেই, কেবল আটি আর চামড়া; খেলে হয় অম্লশূল । ভেতরে যার যে ভাব থাকে, তার কথাবার্তায় তা বেরিয়ে পড়ে যেমন মুলো খেলে তাঁর ঢেকুর তোলে মুলোর গন্ধ বেরোয় । তেমনি সংসারী লোকেরা সাধু সং করতে এসে বিষয়ের কথাই বেশি বলে থাকে । সংসারী জীব মনেতে সর্বদা ভগবানকে স্মরন-মনন করতে পারলে তাহাদের আর অন্য কোনো সাধনের দরকার হয় না । সংসারের ভিতর ও বিষয় কাজের ভিতর রাতদিন থাকলে ঈশ্বরে মনে হয় না । মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁর চিন্তা করা বড় দরকার । প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জনেনা গেলে ঈশ্বরে মন রাখা বড়ই কঠিন ।

বদ্ধজীবেরা ঈশ্বরচিন্তা করে না । যদি অবসর হয় তাহলে না হয় আবোল তাবোল ফালতু গল্প করে, নয় মিছে কাজ করে । জিজ্ঞেস করলে বলে, আমি চুপ করে থাকতে পারি না, তাই বেড়া বাঁধছি । হয়তো সময় কাতে না দেখে তাস খেলতে আরম্ভ করে ।

ব্যাকুলতা

কথাটা এই,ঈশ্বরকে ভালবাসতে হবে । মা যেমন ছেলেকে ভালবাসে, সতী যেমন পতিতাকে ভালবাসে বিষয়ী যেমন বিষয়কে ভালবাসে । এই তিনজনের ভালোবাসা, এই তিন টান একত্র করলে যতখানি হয়, ততখানি ঈশ্বরকে দিতে পারলে তাঁর দর্শন লাভ হয় । ব্যাকুলতা না এলে কিছুই হয় না । সাধুসঙ্গ করতে করতে ঈশ্বরের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হয় । যেমন বাড়িতে কারোর অসুখ হলে সর্বদাই মন ব্যাকুল হয়ে থাকে, কিসে রোগী ভালো হয় । আবার কারও যদি কর্ম যায় , সে ব্যাক্তি যেমন অফিসে অফিসে ঘুরে বেরায়, ব্যাকুল হতে হয়, সেইরূপ । এরকম মনে করা ভালো নয় যে, আমার ধর্মই ঠিক, আর অন্য সকল ধর্ম ভুল । সব পথ দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায়, আন্তরিক ব্যাকুলতা থাকলেই হলো। অনন্ত পথ ও অনন্ত মত। অনুরাগ হলে ঈশ্বর লাভ হয় । খুব ব্যাকুলতা চাই । খুব ব্যাকুলতা হলে সমস্ত মন তাতে গত হয় । ঈশ্বর কে দর্শন করার জন্য যখন প্রাণ আঁটু পাঁটু হয় তখন এই ব্যকুলতা আসে । গুরু শিষ্যকে বললেন, এসোতো মায় দেখিয়ে দিকিরূপ ব্যাকুল হলে তাকে পাওয়া যায়, এই বলে একটি পুকুরের কাছে নিয়ে শিষ্যকে জলে চুবিয়ে ধরলে, তুলিলে পর শিষ্যকে জিজ্ঞেস করলে, তোমার প্রাণ কিরকম হচ্ছিল? সে বললে, প্রাণ আঁটু পাঁটু কচ্ছিল । ঈশ্বরের শরণাগত হয়ে তাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তিনি শুনবনেই শুনবেন- সব সুযোগ করে দেবেন । যেপথেইযাও, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শাক্ত, ব্রহ্মজ্ঞান- ওই ব্যাকুলতা নিয়েই কথা । তিনিতো অন্তর্যামী, ভুল পথে গিয়ে পড়লেও দোষ নেই যদি ব্যাকুলতা থাকে । তিনিই আবার ভালো পথে তুলেনেন। ঈশ্বর আছেন বলে বসে থাকলে হবেনা । ব্যাকুল হয়ে তাঁরকাছে যেতে হবে । নির্জনে তাঁকে ডাকো । প্রার্থনা কর ।

সরলতা

সরল না হলে ঈশ্বরে চট করে বিশ্বাস হয় না । বিষয়বুদ্ধি থেকে ঈশ্বর অনেক দূরে । বিষয়বুদ্ধি থাকলে নানা সংশয় উপস্থিত হয়, আর নানারকম অহংকার এসে পড়ে- পাণ্ডিত্যের অহংকার, এইসব ঈশ্বরপ্রাণের অন্তরায় ।

সরলতা পূর্ব পূর্ব জন্মে অনেক তপস্যা করলেও হয় না । কপটতা, পাটোয়ারী বুদ্ধি এসব থাকলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না ।

বিশ্বাস যত বাড়বে, জ্ঞান ততো বাড়বে । যে গরু বেছে বেছে খায়, সে ছিড়িক ছিড়িক করে দুধ দেয় । আর যে গরু শাক, পাতা, খোসা, ভূষি যা দাও গব গব করে খায় সে গরু হুড়হুড় করে দুধ দেয় । ঠিক বিশ্বাসের দ্বারাই তাঁকে লাভ করা যায়, আর সব বিশ্বাস করলে তাঁর শীঘ্র হয় ।

হাবাতোগুলোর বিশ্বাস হয় না । সর্বদাই সংশয় । আত্মার সাক্ষাৎকার না হলে সব সংশয় যায় না ।

ঈশ্বরের নামে এমন বিশ্বাস হওয়া চাই কি! আমি তাঁর নাম করেছি আমার এখন পাপ থাকবে না ! আমার আবার পাপ কি? আমার আবার বন্ধন কি?

বহুভাবে এককে জানা

ছাদের উপর উঠতে হলে মই, বাঁশ, সিঁড়ি ইত্যাদি নানা উপায়ে যেমন ওঠা যায়, তেমনি এক ঈশ্বরের কাছে যাবার অনেক উপায় আছে । প্রত্যেক ধর্মই এক একটি উপায় । ঈশ্বর এক, তাঁর অনন্ত নাম অ অনন্ত ভাব । যার যে নামে ও যে ভাবে ডাকতে ভালো লাগে, সে সেই নামে ও সেই ভাবে ডাকলে দেখা যায় ।

যেমন গ্যাসের আলো এক স্থান হতে এসে শহরের নানা স্থানে নানা ভাবে জ্বলছে, তেমনি নানা দেশের নানা জাতের ধার্মিক লোক সেই এক ভগবান হতে আসছে । যত মত তত পথ । যেমন বারদীধামে আসতে হলে কেউ নৌকায়, কেউ গাড়িতে, কেউ বা হেঁটে আসে, সেইরকম ভিন্ন ভিন্ন মতের দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন লোকের সচ্চিদানন্দ লাভ হয়ে থাকে । মা-র ভালোবাসা সব ছেলের প্রতি সমা, কিন্তু কোনো ছেলের জন্য লুচি, কারও জন্য খই-বাতাসা প্রভৃতি যার আবশ্যক বোঝেন, সেই রকমের ব্যবস্থা করে থাকেন । সেইরূপ ভগবান বিভিন্ন সাধকের শক্তি ও সাধ্যানুযায়ী সাধনের ব্যবস্থা করেন । যার বিশ্বাসের অভাব, তারই অন্যের ধর্মকে নিন্দা করে ও আপনার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে দল পাকায়; আর যারা কেবল সাধন ভজন করতে থাকে, তাদের ভেতর কোনোরূপ দলাদলি থাকে না; যেমন পুষ্করিণী বা ডোবায় দল জন্মায়, নদীতে কখনও জন্মায় না ।

ভগবান এক; সাধক ও ভক্তেরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ও রুচি অনুসারে তার উপাসনা করে থাকেন । যেমন গৃহস্থেরা একটা বড় মাছ বাড়িতে এলে কেউ ঝোল করে, কেউ তেল হলুদে চচ্চড়ি করে, কেউ ভাতে দিয়ে, কেউ কেউ বা অম্বল করে খেয়ে থাকে ।

সেইরূপ যাদের যেমন রুচি তারা সেই রকম ভাবে ভগবানের সাধন ভজন ও উপাসনা করে থাকে । যেমন জল এক পদার্থ- দেশ, কাল, পাত্র ভেদে তার ভিন্ন ভিন্ন নাম হয় । বাঙালিরা জল বলে, হিন্দীতে পানি বলে, ইংরেজিতে ওয়াটার বা একোয়া বলে । পরস্পরের ভাষা জানা না থাকলে একের কথা অন্য কেউ বুঝতে পারে না, কিন্তু জানলে আর ভাবের কোনোরূপ ব্যতিক্রম হয় না ।

ভগবানের নাম ও চিন্তা যে রকম করেই কর না কেন, তাতেই কল্যাণ হবে । যেমন মিছরির রুটি সিধে করে খাও আর আড় করে খাও, খেলে মিষ্টি লাগবেই লাগবে । যাঁকে নানা নামে ডাকছে; এক ব্যক্তিকেই ডাকছে । এক পুকুরের চারটি ঘাট । হিন্দুরা এক ঘাটে জল নিচ্ছে বলছে জল; মুসলমানরা আর এক ঘাটে নিচ্ছে বলছে পানি; ইংরেজরা আর এক ঘাটে নিচ্ছে বলছে ওয়াটার । আরবীয়রা আরেক ঘাটে নিচ্ছে তারা বলছে আব্‌ ।

মহাপ্রয়াণে বাবা লোকনাথ

মৃত্যু শরীরের ধর্ম । এই পরিবর্তনশীল জগতে যার জন্ম আছে, তার মৃত্যু সুনিশ্চিত । তাই কবি লিখেছেন,

জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে, চিরস্থির কবে নীড় হাঁয়রে জীবন নদে ।

একবার কথা প্রসঙ্গে বাবা লোকনাথ তাঁর অতি প্রিয় ভক্তকে বলেন, “ আমি মৃত্যুর সময় অতিক্রম করেছি এবং বেঁচে আছি এই অবস্থায় নিদ্রায় আমার মৃত্যু হবে । তাই কোনো ভক্তই তাঁকে কোনো সময় দুটি চোখের পাতা এক করতে দেখননি । রাতেও কিছুক্ষণের জন্য তিনি কাঠে হেলান দিয়ে জাগ্রত অবস্থায় বিশ্রাম করতেন ।”

ভক্ত শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছেন, “ বাবা লোকনাথ স্বইচ্ছায় পুরুষ, ইচ্ছা করলে তিনি এখনই শরীর ত্যাগ করতে পারেন । অথবা দীর্ঘকাল পর্যন্ত দেহ ধারণ করতে পারেন ।”

পরমপুরুষ লোকনাথের লীলা সংবরণের কাল আগত প্রায় । ১৬০ বছরের যোগাসিদ্ধ দেহটার অস্তিত্ব তাঁর খেয়াল থাকে না । এই সময় এক ভক্ত আসেন বাবার চরণ দুইটি ধরে বিশ্রান্তভাবে অশ্রু বিসর্জন করে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করেন । তাঁর একমাত্র পুত্র সন্তান কাল যক্ষ্মা ব্যাধিতে মৃত প্রায় । একমাত্র বাবা লোকনাথ ছাড়া কারোরই সাধ্য নাই তাকে বাঁচায় । মৃত প্রায় সন্তানের দিকে কৃপাময় প্রভু তাঁর করুণা দৃষ্টি প্রসারিত করেন ।

বলেন তোর সন্তানের যে প্রারদ্ধ ফুরিয়েছে । ওকে যে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না । কিন্তু মায়ামুগ্ধ পিতার কাছে একথা বিশ্বাস নয় । যা শিবের অসাধ্য এই মহাপুরুষের এক মুহূর্তে কৃপা সফল হতে দেখেছে অগণিত ভক্ত । সুদীর্ঘ ২৬ বছর ধরে । তাই তিনিও তাঁর অকুণ্ঠ বিশ্বাসের কথা প্রভুর অপার লীলার কথা বলতে থাকেন । তুমি চাইলেই অসম্ভব সম্ভব হবে । বলেন করুণাময় প্রভুর হৃদয় দ্রবীভূত হয় । ঠিক আছে, “ তোর সন্তানের রোগ আমি আমার শরীররে গ্রহণ করিলাম । তোরা ফিরে যা ।”

বাবার ভবিষ্যৎ বাণী বৃথা যায় না । ছেলেটি যক্ষ্মা রোগের হাত থেকে মুক্তি লাভ করে । সেই কালব্যাধি বাবা গ্রহণ করে কষ্ট ভোগ করতে থাকেন । কিন্তু ছেলেটির কয়েক মাসের মধ্যেই হঠাৎ মৃত্যু হয় । বাবা বলেছিলেন, “ওর সময় শেষ হয়েছে ওকে যেতে দে ।” এই ব্যাধি তাঁর শরীরে সর্বত্র গ্রহণ করেন, কেবল পার্থিব দেহটা ত্যাগের জন্য এ জীবনমুক্ত মহাপুরুষের এক লীলা যেমন দেখি শ্রীরামকৃষ্ণ দেহ ত্যাগের পূর্বে তাঁর কণ্ঠে নিলেন ভক্তের দেওয়া গরল ।“এও যে মায়ের দেওয়া । ” এর আগেও তো বাবা লোকনাথ কতবারই কত ভক্তের দুরারোগ্য ব্যাধি সুস্থ করে নিজের শরীরে গ্রহণ করে ভোগ করেছেন । কিন্তু সেতো সাময়িক এক দুইদিনের মধ্যে যে সুস্থ হয়ে উঠতেন । এবার যক্ষ্মার প্রাণান্ত করে কাশি এবং সর্ব শরীরের কষ্ট কমে না কেন? বাবার মধ্যে কোনো বিদ্যা নেই । তিনি যেন আকাশে অবস্থান করছেন । কিন্তু তাঁর শরীরটা দিনে দিনে অবনতির দিকে এগিয়ে যায় । মহা প্রয়াণের কয়েকদিন পূর্বে বাবা লোকনাথ ভক্তদের কাছে হঠাৎ প্রশ্ন করেবলেন। “বল দেখি দেহের পতন হলে কিরূপ সৎকার হওয়া ভালো ।” অধিকাংশ ভক্তই অগ্নি দ্বারা দেহের অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বললেন ।বাবাও বলে গেলেন, “পতন হইলে আমার দেহ অগ্নি দ্বারা দগ্ধ করিও । ”

দেহের ক্রমঅবনতি লক্ষ্য করে বাবা লোকনাথ মহাপ্রয়াণের সময়টি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । অচিরেই ভক্ত সমক্ষে ১৯শে জ্যৈষ্ঠ দিন্টিতে তিনি তাঁর নশ্বরদেহ ত্যাগ করবেন ইচ্ছা প্রকাশ করেন । বাবা লোকনাথের এই সিদ্ধান্ত বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই ভক্তদের অন্তরে অনুভূত হয় ।

লোকনাথ আরও বলেন, “আমি স্থুলদেহ ত্যাগ করে সূক্ষ্মদেহে প্রবেশ করিব । আমি তোমাদের ছেড়ে না যাইব ।” “ রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও- আমিই রক্ষা করিব ।” লোকমুখে এই কথা সঙ্গে সঙ্গে প্রচার হলো । দলে দলে ভক্তগণ বাবাকে শেষবারের মতো দর্শন করতে আসল । আশ্রম প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য হলো । সবার চোখে অশ্রু ।

বাবা লোকনাথ ছিলেন সকলের মাতা, পিতা, বন্ধু, আর গুরু । ভক্তদের বাসনা পূরণে বাবা ছিলেন কল্পতরু লোকনাথ সকল ভক্তকেই রক্ষা করতেন সর্বশক্তি দিয়ে । সকাল ৯ ঘটিকায় ছিল শুভযোগ । মা কমলা (গোয়ালিনী মা) মিয়ে আসেন বাল্যভোগ । স্বহস্তে বাবা বাল্যভোগ গ্রহণ করেন । এবং নিজ হস্তে বাবা বাল্যভোগ বিতরণ করেন । সব ভক্তই নিজ হস্তে বাবার প্রসাদ গ্রহণ করলেন । বাবা লোকনাথ ভক্তগণকে এত ভালোবাসতেন যে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,-

“ যা পেয়েছি, যা হয়েছি যা কিছু মোর আশা না জানে ধায় তোমা পানে সকল ভালোবাসা ।”

নীরব নিস্তব্ধ সবাই । কারও মুখে কোনো কথা নেই । ক্রমে সমাধিস্থ বাবা নিশ্চল হলো ।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন । বাবার দেহ বিল্ববৃক্ষ তলে এনে রাখা হলো । দেহ সৎকারের সব আয়োজন করা হলো । আশ্রমের দক্ষিণ পাশে ঠিক পূর্ব কোণে চিতায় সজ্জিত করা হলো বাবার মরদেহ । শ্রেষ্ঠ শিষ্য রামকুমার চক্রবর্তী মুখাগ্নি করলেন । অবশেষে দাহকৃত্য সম্পন্ন হলো । কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন ভক্তগণ । ভক্তগণ বাবা লোকনাথের প্রাণ । বাবার অভয় বাণী মনে পড়ে যায়-“রণে, বনে, জলে-জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও- আমিই রক্ষা করিব ।”

অমৃত কথা

“বাক্যবাণ, বিত্ত-বিচ্ছেদবাণ, বন্ধু-বিচ্ছেদবাণ- এই তিনটি বাণ যে সহ্য করতে পারবে, সে মৃত্যুকে জয় করতে পারে ।”
-শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

স্বামীবাগে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার আশ্রম ও মন্দির এবং শক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মথুরামোহন মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী

মথুরা মোহন মুখোপাধ্যায় বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার ( পূর্বে ঢাকা জেলার) বিক্রম্পুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন । বাবা গুরু প্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও মা ব্রহ্মময়ী দেবী । তিন ভাই ললিতমোহন মুখোপাধ্যায়, মথুরামোহন মুখোপাধ্যায়, লাল্মোহন মুখোপাধ্যায় ও পাঁচ বোন ছিলেন । স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী । পৈত্রিক ভূমি কিছু ছিল তা পদ্মায় বিলুপ্ত হয়ে যায় । তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ।

মথুরবাবু যখন প্রথম বারদীতে যান, তখন তাঁহার বয়স ছিল ১৭/১৮ বছর । তখন এফ.এ.পাস করে তিনি জুবিলী স্কুলে চাকরি করতেন সামান্য বেতনে । ঢাকাস্থ লক্ষ্মীবাজারের লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ বাড়িতে রোজ সকাল বিকাল ধর্ণা দিয়ে থাকেন । বেশ কিছুদিন থাকায় হঠাৎ একদিন সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করার সময় তিনি উপলব্ধি করলেন যে লক্ষ্মীনারায়ণের দেহ হতে এক তেজময় জ্যোতি তার দেহের মধ্যে প্রবেশ করল এবং দৈব আদেশ হলো, “বারদী যাও । এখানে শ্রী শ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী আছেন ওঁনার কৃপায় তোমার মঙ্গল হবে ।”

অনেক চেষ্টা করে বারদী গ্রামের খোঁজ খবর নিয়ে বারদী গ্রাম কোথায় তার হদিস পাওয়া গেল । সোনারগাঁয়ে বৈদ্যর বাজারে মেঘনা নদীর পাড়, সেইখান থেকে নৌকা করে বারদী গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন । পরদিন খুব ভোর বেলা তিনি বারদী পৌঁছলেন । বারদী আশ্রমের নিকটে গিয়া আশ্রমের মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে দাঁড়ালেন । কিছুক্ষণ পরে বাবা বাল্যভোগ সমাপন করিয়া ঘর হতে বআহির হলেন ।

বাবা লোকনাথের বিশাল আজানুলম্বিত শিবমূর্তি দর্শ্নে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন । কিছুই মুখ হতে বের হল না । বাবা লোকনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, “ কেন এসেছ, নাম কি? ব্রাহ্মণ? গোত্র কি?” কোনো উত্তর পান নাই । অন্তর্যামী লোকনাথ জানেন বাবা রাগতঃভাবে বললেন, “আমি ডাক্তার নই, কবিরাজ নই । আমাকে বিরক্ত করতে আসছ কেন? এখানে কিছুই হবে না ।” তিনি ভিতরে চলে গেলেন । বাবা লোকনাথ বাল্যভোগ আহার করিয়া কুল্কুচি করিয়া যে জল বাবা লোকনাথ ফেলে গেলেন তার কিছু তিনি খাইলেন । ৩/৪ ঘণ্টা তিনি অপেক্ষা করিয়া বাজার হতে কিছু দই-চিড়া এনে খাইলেন । তারপর সেই দিন আর ঢাকায় ফিরে যাবার আর কোনো উপায় ছিল না । রাতে কোনো নাগ চৌধুরী বাড়িতে রাত কাটালেন । পরের দিন ভোর না হতেই বাবা লোকনাথ তাঁর নিত্য সেবক জানকীনাথ চক্রবর্তীকে ডাকিয়া বলিলেন, “হায়রে এই সুন্দর যুবকটি কোথায় গেল ।” জানকীনাথ চক্রবর্তী বললেন, “আপনি তো তাকে গালাগালি করে তাড়াইয়া দিলেন । সে কোথায় আছে কি করিয়া বলিব ।মন্দির থেকে গিয়ে নাগেদের বাড়িতে আছে ।” জানকীনাথ চক্রবর্তী মথুরবাবুকে নিয়ে আসলেন । বাবা লোকনাথ পুত্রসুলভ আচরণ করলেন । গীতা থেকে কয়েকটি শ্লোক বলতে মথুর বাবুকে বললেন । মথুরবাবু সুন্দরভাবে শ্লোক বললেন । বাবা লোকনাথ মথুরবাবুর শরীরে হাত বুলাইয়া বললেন, তুমি শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবে । জুবিলী স্কুলের চাকরী ছেড়ে দিবে । ঢাকার যে জায়গায় সূর্যের আলো সকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে সেখানে লতাপাতা দিয়ে ঔষধ তৈরী কর । শীঘ্রই ধনী হয়ে যাবে । ঢাকায় আসিয়া ৮৪/১ স্বামীবাগ রোডে ১৯০১ সনে শক্তি ঔষধালয় নাম দিয়ে আয়ুর্বেদীয় ঔষধ তৈরী করতে আরম্ভ করলেন । ঔষঢের মকরধ্বজ, চ্যবনপ্রাস উল্লেখযোগ্য । শক্তি ঔষধালয় বিরাট আকার ধারণ করে ।সমগ্র ভারতবর্ষে, ব্রহ্মদেশে শক্তি ঔষধালয়ের শাখা-প্রশাখা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শক্তি ঔষধালয়ের নাম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে ।

মথুরা মোহন মুখোপাধ্যায় ১৯০১ সনে লোকনাথ বাবার আস্রম (শক্তি ব্রহ্মচর্যাশ্রম) প্রতিষ্ঠিত করেন ।বাবা লোকনাথের কৃপায় মথুরবাবু ধনাঢ্য হয়ে যান । ৪৪, শরৎগুপ্ত রোডে বিরাট বাড়ি তৈরী করেন । জীবনের শেষ দিকে কিছু পারিবারিক অশান্তি দেখা দেয় । তিনি কলকাতা চলে যান । মথুরবাবু কলকাতার সেন্ট্রাল রোডে বাড়ি করেন । ৫-৬ বছরেই বাড়িতে বসবাস করেন । পরে মথুরবাবু কাশীধামে চলে যান এবং ১লা ডিসেম্বর ১৯৪২ সনে দেহত্যাগ করেন । ১৯৫৯ সনে অনিল মুখার্জী শক্তি ঔষলায়ের কাজে যোগদান করেন স্বীয় মেধা ও কর্মক্ষমতায় ১৯৬৫ সন থেকে অনিল কুমার মুখার্জী শক্তি ঔষধালয়ের নির্বাহী পরিচালক হন । তিনি মন্দির পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হন । মন্দিরকে পুণ্য তীর্থভূমিতে পরিণত করেন । ২০১৪ সনের ১১ই নভেম্বর অনিল কুমার মুখার্জী কলকাতা নার্সিং হোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । বাবা লোকনাথের মন্দির ও আশ্রম যতদিন থাকবে ততদিন শক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মথুরা মোহন মুখোপাধ্যায় এবং বাবা লোকনাথের মন্দিরকে পুণ্য তীর্থভূমিতে পরিণত করার সফল রূপকার অনিল মুখার্জী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ।

প্রয়াত অনিল কুমার মুখার্জী

পরম দয়াল বাবা লোকনাথের কৃপাধন্য অনিল কুমার মুখারর্জী ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার রায়পুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা ছিলেন প্রয়াত দুর্গাপ্রসন্ন মুখার্জী শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত । মা প্রয়াত অনুপমা দেবী । যার ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা সুবিদিতা । দুইজন ছিলেন অসহায় মানুষের চোখের মণি । দুর্গাপ্রসন্ন মুখার্জীর দুই স্ত্রী স্নেহলতা দেবী ও অনুপমা দেবী । স্নেহলতা দেবীর তিন পুত্র । অনুপমা দেবীর দুই পুত্র শান্তিরঞ্জন মুখার্জী ও অনিল কুমার মুখার্জী । কুমার মুখার্জী পাঁচ কন্যা সন্তানের জনক, কোনো পুত্র সন্তান ছিল না । পৈত্রিক নিবাস রায়পুরা হলেও শৈশব কেটেছে মাতুলালয়ে । টাঙ্গাইল জেলার দেলদোয়ার উপজেলার হিঙ্গানগর গ্রামে । তাঁর শিক্ষাজিবন শুরু হিঙ্গানগরের প্রাইমারী স্কুলে । ১৯৫৪ সনে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাস করেন । ১৯৫৯ সনে ঢাকার স্বামীবাগস্থ শক্তি ঔষধালয়ে একজন কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন । বাব লোকনাথের প্রতি তাঁর অসাধারণ ভক্তি ছিল । শীঘ্রই বাবা লোকনাথের কৃপাধন্য হয়ে পড়েন তিনি । স্বীয় মেধা, সদাচার, সদালাপের ফলে পরবর্তী সময়ে তিনি শক্তি ঔষধালয়ের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন । দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে ধনাঢ্য হয়ে পড়েন । ঐ সময়ে তিনি সবামীবাগস্থ বাবা লোকনাথের মন্দির পরিচালনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মন্দির পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হন । সভাপতি থাকাকালীন সময়ে ভক্তগণের সহায়তায় মন্দিরের সংস্কার ও উন্নয়নে মনোযোগ দেন । ১৯৮৯ সনে মন্দিরের প্রথম সংস্কার করেন । তিনি সভাপতি থাকাকালীন ভক্তগণের সহায়তায় বিরাট তৈলঙ্গ স্বামী নির্মাণ করেন ।

তৈলঙ্গ স্বামী ভবন নির্মাণে চট্টগ্রামের বিনয়কৃষ্ণ নাথের অবদান উল্লেখযোগ্য । ভক্তগণের সহায়তায় তার তত্ত্বাবধানে শিবমন্দির, কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা হয় । এতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয় । ফলে শত শত ভক্ত আসেন । অনিল কুমার মুখার্জীকে সফল রূপকার বলা চলে । তারই উদ্যোগে স্বামীবাগে লোকনাথ বাবার আশ্রম ও মন্দির পুণ্যতীর্থ ভূমিতেপরিণতহয়েছে।তৈলঙ্গস্বামীভবনেঅফিসস্থানান্তরকরেন।তৈলঙ্গভবনেমেডিকেলসার্ভিসসেন্টারস্থাপনকরেন।সুযোগ্যচিকিৎসকগণরোগীদেরচিকিৎসাদিয়েথাকে।তৈলঙ্গস্বামী ভবনে প্রতিবছর দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা হয়ে থাকে । তৈলঙ্গ স্বামী ভবনেই বহিরাগত ভক্তদের থাকার সুব্যবস্থা আছে । প্রতিবছর ১৯শে জ্যৈষ্ঠ বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণ দিবস তৈলঙ্গ ভবনে পালিত হয় । ১৯৮০ সনে বারদীর সম্মানিত নাগ চৌধুরী পরিবারের সম্মানিত সদস্য সেবায়েৎ জ্যোতিপ্রসাদ নাগ চৌধুরী অনিল কুমার মুখার্জীকে বারদী ধামকে পরিচালনা করার দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং তাঁকে বারদী ধামের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত করেন । অনিল কুমার মুখার্জী বারদী ধামের উন্নয়ন করেন । ফলে বারদী ধাম পবিত্র পুণ্যতীর্থ ভূমিতে পরিণত হয় । পরে সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন । ১৯৯২ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের নিয়ে লোকনাথ সেবা সংঘ গঠন করেন । উদ্দেশ্য শিক্ষিত তরুণদেরকে লোকনাথের সেবাদর্শে উদ্বুদ্ধ করা এবং বাবা লোকনাথের সেবাদর্শে ঘরে ঘরে প্রচার করা ।নেতাজী সুভাশ বসুও বলেছেন বাবা লোকনাথের দর্শন অনুসরণ ছাড়া তরুণদের চরিত্র গঠন হতে পারে না । অনিল কুমার মুখার্জীর অক্লান্ত পরিশ্রমে বাবা লোকনাথের মধুময় নাম প্রচার করে বাবা লোকনাথের কৃপাধন্য হয়েছেন । মহাযোগী লোকনাথ প্রেমী অনিল কুমার মুখার্জী ১১ই নভেম্বর ২০১৪ খ্রি. তারিখে বিকাল ৪-৩০ মিঃ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কলকাতার নার্সিং হোমে ।

তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শতকোটি প্রণাম ও কৃতজ্ঞতা জানাই ।
কবির ভাষায়-
“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণের পরে তাই করে গেলে দান ।”

অমৃত কথা

“ এ যুগে সত্য কথা বলার চেয়ে তপস্যা আর নেই ।”
-স্বামী বিবেকানন্দ ।

লীলাময় ভগবান বাবা লোকনাথ

৷৷ এক ৷৷

লীলাময় ভগবান লোকনাথকে একবার কোনো ফৌজদারী মামলায় সাক্ষী দেওয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে ঊপস্থিত হতে হয় । ম্যাজিস্ট্রেট বাবার সুদীর্ঘ দেহখানির দিকে একাবার দৃষ্টিপাত করে প্রশ্ন করেন, বয়স কত?

বাবার সহজ উত্তর ১৫০ কি ১৫৫ বছর । উত্তরটা বাবা যত সহজে দিলেন তত সহজে কেউ কথাগুলো বিশ্বাস করলো না, মোক্তারেরা তাই একটু উপেক্ষার ছলে বলে উঠলেন, সাক্ষীর ভোলা উচিৎ নয় যে, আদালতে দাঁড়িয়ে অবাস্তব কথা বলা যুক্তিসঙ্গত নয় । নির্বিকার বাবা উত্তর করেন, “ আচ্ছা তোমরা যা ভালো বোঝ তাই লিখে নাও ।”

বিপক্ষের মোক্তারেরা জেরা করতে এসে সাক্ষীর বৃদ্ধ বয়স এবং ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি বশত ঘটনাটি দেখা সম্ভব নয়, সে কথাই প্রমাণ করতে প্রস্তুত হলেন । প্রশ্ন করলেন বাবাকে- আপনি নিজেই বললেন যে, আপনার বয়স দেড়শত বছর । সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় যে, এত বয়োবৃদ্ধ কোনো ব্যক্তির পক্ষে দূরের কোনো বস্তুকে বা ঘটনাকে ঠিক ঠিক প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয় । এমতাবস্থায় আপনার সাক্ষের সত্যতা কিভাবে প্রমাণ সম্ভব? খেয়ালী মহাযোগীর মনে প্রশ্নের উত্তরটা এবং দূরে অবস্থিত এক বৃক্ষের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, “ ঐ যে বৃক্ষটি দেখা যায় তাতে কি কোনো প্রাণী আরোহণ করছে দেখতে পাও?” এমন অবান্তর প্রশ্নের উত্তরটা সংক্ষেপে সমাধান করে মোক্তার মহাশয়- ‘না’ ।

বাবা লোকনাথের মুখে এই প্রশ্ন আদালতের বহু মানুষই বেশ আগ্রহী এবং উৎসুক হয়ে ওঠেন এবং তারাও সমবেতভাবে দূরে বৃক্ষটি খুব মনোযোগ সহকারে দেখতে চেষ্টা করেন । কিন্তু কোনো প্রাণীর অস্তিত্বই তাদের চোখে পড়ে না ।

বাবা বলেন, “ খুবই আশ্চর্যের বিষয় তোমরা যুবক অথচ এত কাছের বস্তুকেও দেখতে পাও না, এমনই ক্ষীণ তোমাদের দৃষ্টি । একটু ভালো করে দেখা চেষ্টা করলেই দেখতে পাবে একদল লাল পিপীলিকা শ্রেণিবদ্ধভাবে মাটি থেকে গাছটির উর্ধ্‌বদিকে আরোহণ করছে । আমি বেশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি ।”

এমন মজার ঘটনা সচরাচর আদালতে সংঘটিত হয় না, তাই কাছারিশুদ্ধ লোক বাবার কথা শোনা মাত্র দ্রুতবেগে মোক্তার বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যান এবং স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখেন, ক্ষুদ্র লাল পিপীলিকার দল সত্যই বাবার কথামত মাটি থেকে গাছটিতে আরোহন করছে ।

।। দুই ।।

বাবা লোকনাথের লীলা প্রসঙ্গে আমরা আরও একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করি যখনই কোনো বন্ধ্যানারী তাঁর শরনাগতি নিয়ে তাঁর কৃপার জন্য অশ্রু বিসর্জন করেছেন মাতৃত্ব লাভের বাসনায়, তখনই আমরা দয়াল প্রভুকে বলতে শুনেছি- ‘যা আমিই তোর ঘরে যাচ্ছি ।’ এমনই কতো নিঃসন্তান নারী হৃদয়ের দুঃসহ যাতনা এবং সামাজিক লাঞ্ছনা থেকে তিনি মুক্তি দিয়েছেন কতো গৃহবধূকে ।

ভারতের বহু সাধক এবং যোগীদের লীলা প্রসঙ্গে আমরা করুণাময় বিগলিত হয়ে বন্ধ্যা নারীকে সন্তান হবার আশীর্বাদ দিয়ে তাদের মনস্কামনা পুর্ণ করতে দেখেছি একাধিকবার ।

কিন্তু সকলের ক্ষেত্রেই “আমি তোর ঘরে যাব,” এমন কথা আশীর্বাদ দেওয়ার লীলা সত্যেই বিরল ।

এমনকি যারা কন্যা সন্তানের জন্য বাবার করুণা ভিক্ষা চাইতেন তাদের ক্ষেত্রেও বাবা বলতেন ঐ একই কথা । অনেকের ক্ষেত্রে একই কথা বলার জন্য বহু ভক্তের মনে সংশয় উদিত হয় । বাবা তো এক, তবে তিনি ক’জনের সন্তান রূপে জন্ম নিবেন? একদিন এক ভক্ত সবার হয়ে সর্বসমক্ষে এই প্রশ্নটি বাবার সামনে উত্থাপন করেন । এক মধুর হাসি ছড়িয়ে যায় তাঁর দিব্য আননে । ভক্ত মনের সংশয় নিবারণকল্পে বলেন, “ ওরে তোদের তো কতদিন বলেছি নিজেকে ছাড়া দুইয়ের অস্তিত্বই বিরাট ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও দেখি না । আমি যে সব হয়েছি । আমি ছাড়া আর কে জন্ম নেবে বল । এই রহস্য তোরা বুঝবি না । বুঝতে গেলে হতে হবে । সে চেষ্টা তোদের কোথায়? একটা সন্তান পেলেই তোরা খুশি, তবে এই নিয়েই খুশি থাক । ”

।। তিন ।।

বারদীর আশ্রমে অবস্থাঙ্কালে কেবল ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে আগত শরণাগত ভক্তই বাবার কৃপাশ্রয় লাভ করে ধন্য হয়েছে তা নয়, সমসাময়িক কালে বিদেশের বহু ভক্ত এবং জন্মান্তরে সংস্কারমুক্ত ব্যক্তিরাও বাবার অহেতুকী কৃপা লাভ হয়ে কৃতকৃতার্থ হয়েছেন । এমনই একটি ঘটনার কথা আমরা শুনতে পাই এক ভক্তের মুখে- ডাঃ নিশিকান্ত বসু তখন আমেরিকার শিকাগো শহরের চিকিৎসক । একদিন তিনি তার চেম্বারে বসে আছেন, এমন সময় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের আমেরিকাবাসী জনৈক মহিলা অসহনীয় শূল বেদনায় যন্ত্রনা কাতর অবস্থায় তার কাছে আসেন এবং নিজের শারীরিক কষ্টের কথা ব্যক্ত করেন,

এ দেশের সব রকম চিকিৎসাই আমি করেছি, ইন্তু কোনো ওষুধের ঠিকমতো ফল পাইনি । এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না । আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একমাত্র ভারতীয় ওষুধের মাধ্যমেই আমি আরোগ্য লাভ করবো । আপনি ভারতীয় ডাক্তার, তাই আমি আপনার সাহায্য নিতে এসেছি ।

ডাঃ বসুর ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার সম্বন্ধে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা না থাকার জন্য নিজের অক্ষমতার কথা ব্যক্ত করেন । হঠাৎ মহিলাটি বলে ওঠেন, “ Well doctor, Who is behind you?” (ডাঃ তোমার পেছনে কেদাঁড়িয়ে আছে?) মহিলাটি সবিস্ময়ে দেখলেন, ডাক্তার মহাশয়ের ঠিক পেছিনেই একদীর্ঘ দেহী জটাজুট মণ্ডিত জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার হাতে একটি ঔষধ দিলেন এবং তাকে আশীর্বাদ করে মুহূর্তের মধ্যে অন্তর্ধান হলেন । ডাক্তারনিশিকান্তবাবুকিন্তুমহাপুরুষেরদর্শনলাভেবঞ্চিতথেকেযান।তারই সামনে সব ঘটে যায় অথচ চোখ থেকেও তিনি কিছুই দেখতে পান না । মহিলাটি তখন আনন্দে বিহ্বল হয়ে ডাক্তার বাবুকে বলছেন, দেখ ডাক্তার, আমি আমার ওষুধ পেয়ে গেছি । বাবা লোকনাথের দিব্য মূর্তির একটি অপরূপ বর্ণনা করেন মহিলাটি এবং বলেন ঐ মহাপুরুষ তাকে আশীর্বাদ করেছেন যে, সে রোগমুক্ত হবে । বারদীর নাগ পরিবার বাবা লোকনাথের বিশেষ কৃপা আশ্রিত । ডাক্তার নিশিকান্ত বাবু ঐ পরিবারের অতি নিকট আত্মীয় (জামাতা) । উত্তরকালে তিনি বারদীতে এসে ঘটনার বর্ণনা করেন এবং বাবা লোকনাথের বিশেষ কৃপাভাজন হয়ে বাবার বিশেষ ভক্তরূপে পরিচিত হন ।

।।চার ।।

একবার কয়েকজন উকিল এসেছেন বাবা লোকনাথকে দর্শন করার জন্য বারদীর আশ্রমে ।

তাঁর সঙ্গ লাভ করে তারা কয়েকদিন আশ্রমে থাকা মনস্থ করেন এবং সেই মত আশ্রমে থেকে যান । ফিরে যাবার দিন মহাপুরুষের চরণে নিজেদের সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করে তারা বাবার অনুমতি ভিক্ষা করেন । বাবা অনিচ্ছা প্রকাশ করেন এবং জিজ্ঞেস করেন, “ আজ তোদের না গেলে হয় না ?” কর্মক্ষেত্রে বিশেষ অসুবিধা থাকার জন্য ইচ্ছা থাকলেও উপায়হীন হয়েই তারা বাবার কাছে সেদিনই যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন ।

উপায়ন্তর না দেখে বাবা লোকনাথ একজন উকিলের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক বলেন, “ যদি তোদের যাওয়া একান্তই প্রয়োজন থাকে তাহলে তোদের বাধা দেবো না, তবে ওকে রেখে যা ।”

কথাগুলো বলেই বাবা চুপ করে যান । কি জন্য যে তিনি ঐ ব্যক্তিকে যেতে বারণ করছেন, তার কোনো কারন তিনি প্রকাশ করেন না, তবে কয়েক দিন আশ্রমে থেকে ভক্তগণ বাবার যোগশক্তির অনেক পরিচয় ইতিমধ্যে পেয়েছেন, তাই এই নির্দেশের পেছনে সত্য নিহিত আছে ভেবে তারা তাকে রেখে বাবার আশীর্বাদ নিয়ে তারা তাদের গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন ।

ত্রিকালদর্শী মহাযোগীর যোগ দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ বর্তমানের মতনই প্রতিভাত, তাই অল্পক্ষণের মধ্যে উক্ত উকিল ভক্তটির ভেদবমি শুরু হয় এবং তিনি প্রাণঘাতি কলেরা রোগে মৃতপ্রায় হন । আশ্রমে গোয়ালিনী মায়ের অক্লান্ত সেবায় ও সন্তানবৎ স্নেহের ছোঁয়ায় এবং সর্বোপরি বাবা লোকনাথের কৃপায় তিনি অল্পদিনের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করেন । সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে নবজীবন লাভ করে বাবার চরণে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে

তিনি বাবার অনুমতি প্রার্থনা করেন । বাবা আশীর্বাদ করে বলেন, “যা আর তোর কোনো চিন্তা নেই । ” প্তহে যেতে যেতে মহাপুরুষের অকল্পনীয় যোগশক্তি এবং অপার করুণাময়ের কথা স্মরণ করে তিনি মুগ্ধ হন, ভাবেন, বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম দিন পথে রওনা হলে হয়তো পথেই তিনি প্রাণ হারাতেন ।

বাবা লোকনাথ বলেছেন- “ ওরে তোদের ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার হ’ল না, দেখলাম নিজেকে । তাঁকে জানতে গেলে হতে হয় ।” এই হওয়ার সাধনায় আপ্তকাম মহাযোগী পূর্ণকে উপলব্ধি করে পূর্ণকুম্ভ হয়েই অমৃত বিতরণের জন্য বারদীতে লীলায় প্রকট হয়েছেন । ধন্য যারা ভগবানকে তাঁর নবরূপে এই ধুলার ধরণীতে লীলা করতে দেখেছেন, সার্থক তাদের মনুষ্য জীবন ।

।। পাঁচ ।।

আশ্রমে একনিষ্ঠ সেবিকা গোয়ালিনী মায়ের উপর এই মহামানবের কৃপা অবিরত ভাবেই বর্ষিত হয়েছে । একদিন গোয়ালিনী মা তাঁর প্রাণপ্রিয় গোঁসাইয়ের (বাবার) কাছে উপস্থিত হলেন এক বিশেষ প্রার্থনা নিয়ে । তাঁর এক অতি নিকট আত্মীয় তাঁর উপর এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন । কলকাতার কালীঘাটের কালীমায়ের কাছে মানত করেছিলেন, তা ফলে যাওয়াতে মানতি রক্ষা করার জন্য অর্থ এবং নানান দ্রব্যাদি তাঁরই কাছে রেখে গেছেন বাবার কোনো কলকাতাবাসী ভক্তের মাধ্যমে মায়ের শ্রীচরণে পৌছানোর জন্য । তাই বাবা যদি কৃপা করে কোনো ভক্তের মাধ্যমে কর্মটি সমাধান করেন ।

ব্রহ্মময় মহাযোগী কথাগুলো শোনেন এবং এক রহস্যময় হাসি খেলে যায় তাঁর জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডলে । বৃদ্ধ মাতার সঙ্গে একটু খেলা করার সাধ জাগে ।

তাই বলেন, “ঐ টাকা ও দ্রব্যাদি আমার কাছে দিলেই চলবে, কলকাতায় পাঠাবার কোনো প্রয়োজন নেই । আমিই কালী ঘাটের কালী ।” এই সত্য বৃদ্ধা গোয়ালিনী মা তাঁর সন্তানসম এই মহাপুরুষের পদতলে থেকে বহুবার উপলব্ধি করেছেন । তাই তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর কক্ষে অতি সযতনে রক্ষিত বস্তুগুলো নিয়ে যখন বাবার কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করতে যাবেন, এই অলৌকিক অতিন্দ্রীয় দর্শন করে তিনি আত্মহারা হন, বাবার কুটীরটি এক দিব্যজ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে, আর তার মধ্যে বাবার আসনে জ্যোতির্ময় কালীঘাটের আনন্দময়ী কালী মা বিরাজ করছেন । মায়ের এই চিন্ময়ীরূপ দর্শন করে তিনি বাহ্যজ্ঞানহারা হয়ে তারই চরণে লুটিয়ে পড়েন । যখন বাহ্যজ্ঞান ফিরে পান দেখেন আসনে বসে আছেন তাঁর প্রাণের ঠাকুর গোঁসাই বাবা । অন্তর দিব্য অন্তরের মহাসারে দর্শন করেন এক উপলব্ধিধর প্রস্ফুটিত কমল- যিনি কৃষ্ণ, যিনি কালী, তিনি শিবরূপে লোকনাথ ।

ভক্ত কতভাবেই ভগবানের প্রেমরস আস্বাদন করেন । যিনি অনন্ত তিনি শান্ত হয়ে ভক্তের ভালোবাসার ডোরে বাঁধা পড়েন স্ব-ইচ্ছায় । কিন্তু ভক্তির এমনই আহাত্ম- তা ভগবানের স্বাধীনতাকে কেড়ে নেয় । ভগবান ভক্তেরও পরাধীন হন, ভক্ত না হলে ভগবানের লীলা জমে না । আর ভগবানকে না পেলে ভক্তের সার্থকতা নেই ।

।।ছয় ।।

এমনই এক ভক্তিময় নারী অন্নদা সুন্দরী দাসী লোকনাথের অপার যোগ ঐশ্বর্যের মহিমার প্রতি আকর্ষিত না হয়ে জননী হয়ে সন্তানের বাৎসল্যরস আস্বাদের জন্য লালায়িত হলেন । লোকনাথ তাঁর ছোট সন্তান, তাঁর ভালোমন্দ,ক্ষুধা তৃষ্ণা নিয়ে তিনি সদাই চিন্তিত । হঠাৎ তার প্রাণ সন্তান সম লোকনাথের জন্য হুহু করে ওঠে,

আর তিনি সব কাজ ছেড়ে ছুটে আসেন আশ্রমে, প্রাণ ভরে দেখেন তার প্রাণ প্রিয় লোকনাথকে । এমনই এক অপরূপ মাধুর্য রসের সাধনায় তাঁর দিন অতিবাহিত হতে থাকে। সেদিন তিনি আশ্রমে এসেছেন । তাঁর প্রাণের গোপালের দিকে অপলকদৃষ্টিতে চেয়ে বসে আছেন তাঁর খুব কাছটিতে, মনের মধ্যে এক অনাবিল শান্তি ছড়িয়ে আছে । এমন সময় বাবা লোকনাথ বলে ওঠেন- “ মা, তুই মা হয়েছিস, কই কোনো দিনতো কোলে করে বসলিনা?”

এই ভগবানের লীলা । কোথাও তিনি স্বইচ্ছায় পূর্ণ পুরুষরূপে ভক্তকে বলেছেন “ আমার শরণাগত হয়, আমার উপর শাস্তাকে? আমি অনাদি অনন্ত।” আবার কোথাও তিনি তাঁর সব ঐশ্বর্যকে ভুলে ভক্তের কোলে ছোট শিশু সেজে কেবল প্রেমের ভিখারী ।তাইতুলসীদাসজীতারা প্রাণের ইষ্ট শ্রীরামচন্দ্রজীর মাহাত্ম্য কীর্তন করতে গিয়ে বলছেন, “ হরি অনন্ত, হরিকথা অনন্ত ।”

অতি সহজ সরল মানুষ অন্নদা সুন্দরী, সরল ভাব নিয়েই বলে, “ বাবা, তোমার অতবড় শরীর আমার এই ছোট্ট কোলে কেমন করে ধারণ করব, তবে তুমি যদি কৃপা কর। তাহলে এসো, দেখি পারি কিনা?” অতি বাধ্য শিশুর মতই বাবা লোকনাথ মহানন্দে এগিয়ে আসেন এবং অন্নদা সুন্দরীর কোলে বসে পড়েন । কিন্তু একি পরম বিস্ময় ! অন্নদা সুন্দরী অনুভব করেন এক দিব্য আনন্দে তিনি বয়ে উঠেছেন এবং লোকনাথের শরীরের ওজন এক খণ্ড শোলা অপেক্ষাও লঘু ।

দিব্য আনন্দে বিহ্বল হয়ে মাতা অন্নদা সুন্দরী বলতে থাকেন, “ বাবা, আমি তোমার সামান্য মেয়ে, জ্ঞানহীন ভক্তিহীন, তাইতো তোমার মহিমা না বুঝে অমন করে বলেছি । আজই আমি বুঝলাম তুমি কৃপা করলে সবই করতে পার । তোমার কৃপার অসাধ্য কিছুই নেই । তুমিই জীবন্ত ভগবান, তুমিই গোপাল কৃষ্ণ ।”

।।সাত ।।

জনৈক ব্রাহ্মণ ভক্ত এসেছে বাবার কাছে । তার বড় ইচ্ছা প্রভুকে সে পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে একবার তার কুটিরে নিয়ে যায়, মহাপুরষের পদধুলিতে পবিত্র হয় তার বাসস্থান । কিন্তু বাবা যেন কোনো কালেই কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেই বারদীর আশ্রম ছেড়ে যান না । তাই তিনি ভক্তকে বোঝাতে চেষ্টা করেন তাঁর অসুবিধার কথা । কিন্তু এই ভক্ত বড় সহজে হার মানার পাত্র নয়, চরণ দুটি ধরে সে অনুনয় বিনয় করতে থাকে, প্রতিশ্রুতি না নিয়ে সে ঐ স্থান ত্যাগ করবেনা । ভক্তবৎসল ভগবানের করুণা হয়, ভক্তের জন্য এতদিনের আচরিত নিয়ম তিনি ভঙ্গ করেন, বলেন- “ আচ্ছা যাব ।”

নির্ধারিত দিনে আমন্ত্রিত অথিতি একে একে আসতে শুরু করে । সাদরে সে সবাইকে আপ্যায়িত করে তার মধুর ব্যবহারে এবং যথাসাধ্য সেবা করে; কিন্তু মন তার পড়ে আছে কখন বাবা আসবেন । গৃহের প্রবেশ পথের দিকে বার বার তার দৃষ্টি ছুটে যায়; কিন্তু কই প্রভু তো আসেন না শেষ অতিথি ভোজন সম্পন্ন করে ফিরে যান । অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয় সে ।

সত্যব্রত বাবা লোকনাথ নিজ মুখে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এইতো মিথ্যা হতে পারে না । মনে মনে খুবই ব্যথিত হয় সে সারারাত বাবার না আসার কারণ চিন্তা করে বিনিদ্র রজনী কাটায়, ভোর হতেই ছুটে যায় বারদীর আশ্রমে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বিনীতভাবে অন্তরের ক্ষোভের কথা নিবেদন করে । অভিমান ভরা স্মরে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার কারণ জানতে চায় ।

কিন্তু বাবার উত্তর শুনে বিস্ময়ের সীমা থাকে না তার,

“ ওরে তুই আমার উপর রাগ করছিস কেন? আমি তো গিয়েছিলাম, তুই তো আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিস ।” বিগত রাত্রে সে মনে মনে অনেক কল্পনাই করছিল; কিন্তু এমন কথা যে বাবা তাকে বলতে পারেন এই তার কল্পনার বাইরে । বাবার কথার পুনরুক্তি করে সে- “ আমি আপনাকে তাড়িয়ে দিয়েছি । এমন কথা আপনি বলতে পারলেন?” রহস্যময় মৃদু হাসিতে লীলাময় প্রভুর আনন্দ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে । তিনি বলেন, “ তোর কি মনে আছে, যে ঘরে মিষ্টান্ন রাখা হয়েছিল, সে ঘরে তুই থাকাকালীন একটি কুকুর দু’বার প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল, তোর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল এই আশা করে যে, তুই একটু মিষ্টি খেতে দিবি, আর তুই নির্দয়ভাবে তাকে লাঠি দিয়ে প্রহার করে দু’বারই তাড়িয়ে দিয়েছিলি । ওরে, আমিই তো গিয়েছিলাম, তুই যদি আমাকে চিনে নিতে না পারিস তো আমার দোষ কোথায় বল?” মুহূর্তের মধ্যে গত দিনের কুকুরটির স্মৃতি তাঁর চিত্তে ভেসে ওঠে । একটি কুকুরের রূপ নিয়ে যে স্বয়ং ভগবান তাকে ছলনা করার জন্য, তাকে পরীক্ষা করার জন্য আসতে পারেন এই যে তার সব যুক্তি বিচারের বাইরে, তার হাতে তার প্রাণপ্রিয় দয়াল ঠাকুর লাঞ্ছিত হয়েছেন এই কথা ভাবতেই তার অন্তর অনুশোচনার গ্লানিতে ভরে ওঠে, অঝোরে অশ্রুধারা নেমে আসে গণ্ড বেয়ে, সেই অশ্রুতে সাক্ষাৎ ভগবানের চরণ দুটি ধুয়ে দেয় সে-অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে বার বার ক্ষমা ভিক্ষা চায় তার কৃত কর্মের জন্য । পরম স্নেহভরে আশীর্বাদ করেন বাবা ।

সর্বভূতেই যে তিনি, কখন কোন রূপ পরিগ্রহ করে ভক্তের কাছে তিনি প্রেমভিক্ষা চাইতে আসবেন তা বোঝা বড় কঠিন । সাধারণত আমরা ভক্তি পথে তাঁর উপাসনা করা কালে মানুষের প্রতি আমাদের ব্যবহারের মধ্যে সংযত ভাব আনতে চেষ্টা করি

কটুবাক্যে বা ব্যবহারের মধ্যে সংযত ভাব আনতে চেষ্টা করি কটুবাক্যে বা ব্যবহারে যাতে অপরে কষ্ট না পায় সে ব্যাপারে সচেতন হই, কিন্তু অবলা জীবজন্তুর প্রতি আমাদের উপেক্ষার ভাবের তেমন কোনো পরিবর্তনের দিকে সচেতনতা থাকে না । লীলাময় প্রভু লোকনাথ এই অলৌকিক লীলার মাধ্যমে ভক্ত এবং সাধক মাত্রকে সচেতন করছেন । বলছেন, “ ঘাট ঘটমে রাম, কখন যে তিনি তোমার কাছে আসবেন, তুমি জান না, সবার মধ্যেই তিনি, এই জ্ঞান করে সবার প্রতি দয়ার ভাব অন্তরে রাখার চেষ্টা করতে হবে, তবেই প্রভু প্রসন্ন হবেন । যে সবার প্রতি সমান ভাব রাখতে সক্ষম, সেই প্রকৃত ভক্ত

।।আট ।।

ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের বাক্‌শক্তি অমোঘ । তাঁর অভয় বাণী কখনও বৃথা যেতে পারে না । মিথ্যাচারী ভ্রষ্ট চরিত্রের মানুষ তাঁর সংস্পর্শে এসে তাঁর লীলায় রূপান্তরিত হয়ে যায় । এমনই এক মিথ্যাবাদী একবার মিথ্যা জাল করার অপরাধে কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্দ্ধিধায় অপরাধ অস্বীকার করে। কিন্তু মনে মনে পাপের ফলের কথা ভেবে সে ভীত হয় । লোকমুখেবারদীর বাক্‌সিদ্ধির কথা শুনে ভাবে, কোনো রকমে একবার মহাপুরুষের অভয় বাণী পেলেই সে এই যাত্রা রেহাই পাবে । বাবা লোকনাথের শরণাগতি নিয়ে বাবার কাছেও মিথ্যা কথা বলে এবং অপরাধ অস্বীকার করে । এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য কৃপা ভিক্ষা চায় সে ।

কথাগুলো শুনেই বাবার মুখ থেকে অভয় বাণী নিঃসৃত হয়- “ তুই মুক্তি লাভ করবি ।” বাবার কথা অভ্রান্ত সত্য , এই জেনে সে মহানন্দে বাবার আশীর্বাফ নিয়ে রওনা হয় ।

কিন্তু পথ রোধ করে দাঁড়ান আশ্রমের এক সেবক, বহুদিন থেকেই এই মানুষটির গতিবিধি সে লক্ষ করেছে, সন্দেহাতীতভাবেই সে জানে যে, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য । কিন্তু বাবার কাছেও মিথ্যা বলতে দেখে সে খুব ক্রুব্ধ হয়ে ওঠে, বলে- বাবা লোকনাথ সাক্ষাৎ ভগবান, সবার অপরাধই তিনি করুণা করে ক্ষমা করেন । আপনি ভালো করেই জানেন যে, আপনি অপরাধী; কিন্তু বাবার কাছেও মিথ্যা বলতে কি আপনার বিবেকে একবারও বাধল না? ভুলে যাবেন না, জেনে শুনে মহাপুরুষের কাছে মিথ্যা আচরণের জন্য মহাপুরুষের বাণী আপনার ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে ।

বাবা লোকনাথই যেন এই সেবকের মধ্য দিয়ে ভর্ৎসনা করলেন । নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় দগ্ধ অন্তঃকরণে সে আবার বাবার কাছে ফিরে যায় । নিজের অপরাধের কথা এবং বাবার কাছে মিথ্যা বলার পাপের জন্য বারংবার ক্ষমা ভিক্ষা চায় । বলে- আমি আপনার শরণাগত হলাম আপনি আমায় ক্ষমা করুন ।

শরণাগত ভক্তের সর্ব অভীষ্ট প্রদান করার জন্যই তো তিনি হিমালয়ের ধ্যানমৌন প্রকৃতির কোল থেকে নেমে এসেছেন, পাপ-তাপক্লিষ্ট নতুন দিগ্‌দর্শন দেখাবার জন্য । তাই মুক্তির পথ দেখাবার জন্য বলেন, “ তুই যদি সত্যিই আমার শরণাগত হয়ে থাকিস, তাহলে আমি যেমন আদেশ করব তা পালন করতে পারবি?”

প্রশ্নের সঙ্গে আদেশ পালনের শক্তিও সঞ্চারিত করেছেন কৃপালু প্রভু । তাই আত্মবিশ্বাসের সুরে ভক্ত বলে ওঠে, আপনি আমায় যা বলবেন আমি তাই করব ।

“ তবে তুই বিচারকের কাছে ফিরে গিয়ে সবার সামনে নিজের দোষ স্বীকার করে তোর কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত কর,- হ্যাঁ আমি যখন তোকে বলেছি মুক্তি লাভ করবি, সে বাক্য কখনই মিথ্যা হবে না ।” বাবার কথাগুলো যেন মানুষটির মনের মধ্যে এক জ্বলন্ত বিশ্বাসের সৃষ্টি করে মহাপুরুষের কৃপাশক্তির বলে বলীয়ান শরণাগত ভক্ত তাঁর প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে । ম্যাজিস্ট্রেটের মনের মধ্যে সন্দেহের উদয় হয়; নিশ্চয়ই কোনোভাবে অভিযুক্ত আসামীর উপর কোনো চাপ সৃষ্টির ফলে তাকে দোষ স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছে, এই ধারণার ফলে তিনি তাকে উচ্চতর ন্যায়ালয়ে পাঠান ।কিন্তু আসামী সেখানে গিয়েও সেই একই কথা সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করে- “ আমিই দোষী ।” শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হাইকোর্টে পাঠানো হয় । সেখানে নিজ দোষ অকপটে স্বীকার করে সে ।

হাইকোর্টের বিচারে দোষী নির্দোষ প্রমাণিত হয় । সব বিচারকের মধ্যে সব জুরির মধ্যে বাবাই যে বসে বসে এত লীলা করলেন এই কথা ভক্তটি বুঝতে পারে । তাই মুক্তি লাভ করে মহানন্দে ছুটে যায় বারদীতে এবং মহাপুরুষের চরণ বন্দনা করে সে । বাবাও তাঁর শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের জন্য অত্যন্ত প্রশন্ন হন এবং জীবনে সৎ পথে থেকে সৎভাবে মানুষের মতন মানুষ হয়ে বাঁচবার জন্য আশীর্বাদ করে তাকে এক নতুন জীবনের পথে এগিয়ে দেন । আরও একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বাবা ভক্তজনকে বিশেষ শিক্ষা দেন যে, সদ্‌গুরু বা ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের সঙ্গে কখনই প্রবঞ্চনা করার চেষ্টা করা উচিৎ নয় ।

।।নয় ।।

একদিন এক বারদী নিবাসী এক ব্যক্তিকে সর্প দংশন করে । মুহূর্তের মধ্যেই বিষের ক্রিয়া সর্ব শরীরে ছড়িয়ে পড়ে ।

ওঝা এবং স্থানীয় বৈদ্যদের সব চেষ্টা বিফল হয় এবং লোকটি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, তখন পরিবারের লোকেরা সংকট মুক্তির জন্য বাবা লোকনাথের নামে পূজার মানত করে । এই সংকল্প করার কিছুক্ষণের মধ্যে মানুষটি সুস্থ হয়ে ওঠে । কিন্তু পরিবারের লোকদের মনের মধ্যে বাবা লোকনাথের কৃপার থেকেও বৈদ্যের চিকিৎসার প্রভাবে প্রাণরক্ষা হওয়ার ভাবটিই প্রধান হয়ে দেখা দেয়, তাই নির্দিষ্ট দিনের মানত রক্ষার পূজার বিষয়ে কারুরই কোনো আগ্রহ দেখা যায় না ।

সুস্থ হয়ে সর্পদষ্ট ব্যক্তিটি তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করে । কিন্তু লীলাময় প্রভু শরণাগতকে কৃপা করতে দ্বিধা করেন না, কিন্তু প্রবঞ্চনা-কপটতার ফল স্বরূপ কষ্ট স্বীকার করতে হয় ভক্তকেই । এক্ষেত্রেও তাই হয় । হঠাৎ সর্পদষ্ট ব্যক্তিটি ঠিক একই স্থানে ব্যথা অনুভব করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্ত শরীরে বিষের ভয়ানক ক্রিয়া দেখা যায় । অসহনীয় যন্ত্রনায় সে জ্ঞান হারা হয় । বিনা কারণে পুনরায় বিষের ক্রিয়া সত্যিই অভাবনীয়, তাই সংকটের মুহূর্তে বাবা লোকনাথের পূজা মানতের কথা সবাত মনে পড়ে যায় । মানত রক্ষা না করার জন্যই যে এই দুর্দৈব এসে উপস্থিত হয়েছে এবার সবারই এই বিষয়ে হুশ হয় এবং কালবিলম্ব না করে বাবার আশ্রমে পূজার ব্যবস্থা করে । ফল পেতেও দেরী হয় না, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গেই রোগী সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয় ।

লোকনাথের অপার যোগ-ঐশ্বর্যের কথা মুখে মুখে চতুর্দিকে প্রচার হওয়াতে দূর-দূরান্ত থেকে কত লোকই আসতেন তাদের দূরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য । বাবার কৃপা দৃষ্টিমাত্রা বা তাঁর কৃপা স্পর্শ মাত্রই যে অভাবনীয় লীলা সংঘটিত হয়েছে ।

।।দশ ।।

কলকাতার এক বিশিষ্ট ধনী শ্রী সীতানাথ দাস বাত-ব্যাধিতে বহুকাল যাবৎ কষ্ট পান । কলকাতার তৎকালীন বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে বহু চিকিৎসাও হয়; কিন্তু দিনে দিনে তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে । এরকম পঙ্গু হয়ে পড়েন তিনি । এই সময় লোকমুখে বারদীর ব্রহ্মচারীর লীলাবিভূতির কিছু কথা তিনি শ্রবণ করেন । মনে জাগে এক গভীর বিশ্বাস । নিশ্চয়ই এই মহাপুরুষের কাছে পৌঁছাতে পারলে এতদিনের ভোগের অন্ত হবে । এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই তিনি তার পরিবারের কয়েকজন এবং দাস দাসীসহ নৌকাযোগে বাবার আশ্রমে পৌছান ।

বারদীতে পৌঁছেই কিন্তু তার মধ্যে এক বিশেষ ভাবের উদয় হয় । তিনি স্থির করেন এত কষ্ট স্বীকার করে বাবার কাছে যখন এসেছেন তখন নৌকায় দাস-দাসীদের সেবা নেওয়ার থেকে বাবার আশ্রমের আঙ্গিনায় রোদে-জলে পড়ে থেকে তাঁর করুণা ভিক্ষা করাই শ্রেয় হবে । আশ্রমের আঙ্গিনায় রক্ষিত একটি খাটের উপর তিনি আশ্রয় নেন । মনের মধ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, যদি মৃত্যুই নিশ্চিত হয় তাহলে যেন এই মহাপুরুষের আশ্রমে এই মহাপুণ্যতীর্থে তার মৃত্যু হয় । দুটি দিন কেটে যায় । তার রোগাক্লিষ্ট দেহের উপর দিয়ে রোদ-বৃষ্টি সবই চলে যায় । পরিবারের মায়ামুগ্ধ জনেরা পারে না এই কষ্টকে মনে মনে স্বীকার করে নিতে । তাই তারা সমবেতভাবে তাকে নৌকায় নিয়ে যেতে চায়; কিন্তু সীতানাথ বাবু অন্তর থেকে অনুভব করেন এক স্বতঃস্ফূর্ত নির্ভরতা এবং বিশ্বাস । শরীরে এত কষ্ট থাকলেও মানসিক জগতে তিনি অনুভব করেন এক বিশেষ পরিবর্তন । কিন্তু যাঁর চরণাশ্রয়ে এসেছেন যাঁর কৃপাবারি পাবার জন্য তিনি চাতকের ন্যায় বসে আছেন, তাঁর দর্শন মেলে না,

এমনকি তিনি কোনো খোঁজও নেন না বা কোনো উক্তিও করেন না । এমন উপেক্ষার জন্য পরিবারের সকলেই কিন্তু ধৈর্যচ্যুত হন । সীতানাথের এমন ভক্তিপূর্ণ শরণাগতিতেও যদি মহাপুরুষের হৃদয়ে করুণার সঞ্চার না হয়, তাহলে এত কষ্ট স্বীকারের অর্থ কী? কিন্তু সীতানাথ বাবুর কোনো অভিযোগ নেই । তিনি সিদ্ধান্তে অটল থাকেন- মৃত্যু হলে যেন মহাপুরুষের চরণেই মৃত্যু হয় ।

পরম করুণার বিগ্রহ বাবা লোকনাথের ভক্তের নিষ্ঠা এবং বিশ্বাসের পরীক্ষা শেষ হয় । তৃতীয় দিন ভোর বেলায় প্রভু তাঁর কুটির হতে বেরিয়ে আসেন এবং ভক্তের কাছে উপস্থিত হন । সীতানাথের সর্ব শরীর রোমাঞ্চিত হয়, এমন করুণাভরা দৃষ্টি দর্শন করে তার অন্তর এক অনাবিল আনন্দে প্লাবিত হয় । তিনি অনুভব করেন যেন সাক্ষাৎ দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন । মনুষ্য শরীরের মধ্যে এমন জ্যোতির্ময় প্রকাশ এই তার কাছে স্বপ্নবৎ মনে হয় । “তোঁকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, এখন ওঠ”- কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে কি যেন অমৃত ঝরে পড়ে, বাবা তাঁর কৃপাহস্ত প্রসারিত করে শরণাগত ভক্তের সব যন্ত্রণা, সব ব্যাধি স্পর্শ মাত্র হরণ করেন- মন্ত্রমুগ্ধের মতন সীতানাথ খাটের উপর উঠে বসেন । শরীরে তার কোনো কষ্ট, কোনো গ্লানি আছে বলে মনে করতে পারেন না; ভগবানের চরণে নিজের শরীরটিকে তিনি সর্বতোভাবে অর্পণ করে দেন । দুই গণ্ড বেয়ে নেমে আসে আনন্দাশ্রুর ধারা এক পলকের কৃপায়, তাঁর জীবনে ঘটে যায় এক বিস্ময়কর রূপান্তর, কেবল বহুদিনের ব্যাধিগ্রস্ত পঙ্গু শরীরটির মধ্যেই নয়, গুরুকৃপা যেন তাঁর শরীর, মন, প্রাণ সবকিছুকে এক নব জন্ম দান করেছে- এসেছিলেন শরীরের ব্যাধি মুক্ত হবার আশা নিয়ে; কিন্তু তার নিষ্ঠা এবং ভক্তি দিয়ে লাভ করলেন জন্ম-জন্মান্তরের ভব্রোগের বৈদ্য গুরুকে ।

ভক্তের ভক্তিকে প্রসন্ন ভগবান লোকনাথ বলেছেন-“ তুই তোর নিজের দেহ, মন, প্রাণ, স্ত্রী-পুত্র, বিষয়-সম্পত্তি সর্বস্ব আমাকে অর্পণ করে আমার আশ্রমের উঠানে রোদে জলে কত কষ্ট সহ্য করেছিস, তোর কষ্টে আমার হৃদয় আদ্র হয়েছে, আমি তোর কষ্টে কেঁদেছি । এখন তুই সুস্থ । তোর আর কোনো চিন্তা নেই । তুই আমাকে যা দিয়েছিস তা আমারই রইল, কেবল তোকে ভোগাধিকার দিলাম । এখন নিশ্চিত হয়ে ফিরে যা । এখন থেকে তোর সব দায়িত্ব আমার ।” এই লীলার মাধ্যমে ভগবান এই সত্য প্রকাশ করলেন যে, কেবল ভক্তই ভগবানের কৃপা লাভের জন্য বা ব্যাধিতে কষ্ট পেয়ে তাঁর কৃপা লাভের আশায় অশ্রু বিসর্জন করেন না, ভগবানও ভক্তের দুঃখ-কষ্টে সমান দুঃখী হন । তিনিও ভক্তের জন্য কাঁদেন । বাবা বলেছেন, “আমি তোর জন্য কেঁদেছি ।” সীতানাথের পরিবারের জনেরা কিন্তু বাবার উপেক্ষার পেছনে যে মঙ্গলময় স্বরূপটি আছে তার কথা চিন্তা করতে পারেননি । সাধারণত আমরা ভগবানের উপর, মহাপুরুষের উপর নির্ভর করি; কিন্তু আমাদের ধৈর্যের শক্তি অতি সীমিত; অল্পতেই আমরা বিশ্বাস হারাই, বলে বলি তিনি থাকলেও আমার ডাক হয়ত শুনছেন না । সবার ডাকই তিনি শোনেন । সীতানাথের মনের মধ্যে তিনিই বিশ্বাসের আলো প্রজ্বলিত করেছিলেন, তাই সেই আলোকে বাবার প্রকৃত মঙ্গলময় রূপটি দর্শন করার জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে রোদে-জলে শারীরিক মানসিক কষ্ট স্বীকার করছিলেন এবং তপস্যার ফল স্বরূপ মঙ্গলময় প্রভুর কৃপা লাভ করেন । বাবা তাকে রোগমুক্ত করে কর্মযোগের অতি সহজ পথটি ধরিয়ে দেন । বিষয় ত্যাগ নয়- বিষয় ভোগের মধ্যে নিরাসক্তির দ্বন্দ্ব ত্যাগের আদর্শটি তিনি শিক্ষা দেন । “আমার” এই মমতাশূণ্য হয়ে, “তাঁর” এই জ্ঞান নিয়ে,এই শুদ্ধ বিচার নিয়ে, বিষয় ভোগ করলেও তাঁরই কৃপায় এই ভোগের মধ্যে দিয়ে ভক্ত হৃদয়ে ত্যাগের আদর্শ নির্লিপ্তা,

নিরভিমানতা এবং নিরাসক্তির ভাব শনৈঃশনৈঃ প্রকাশ লাভ করে । তাই ভবরোগ থেকে মুক্তির সহজ উপায়টি বললেন বাবা লোকনাথ ।

।।এগার ।।

বাবা বসে আছেন বারদীর আশ্রমে আঙ্গিনায় । চোখে পড়ে লাল বস্ত্র পরিহিতা এক নারী মূর্তি তারই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন । এই নারী যে কোনো সাধারণ মনুষ্য মূর্তি নয় তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের । বোঝেন শীতলা দেবী এসেছেন । বাবার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই শীতলাদেবী বলেন, “ আমি এখান দিয়ে যাবই?” কথাগুলোর মধ্য নিজের ইচ্ছা এবং মহাপুরুষের অনুমতির জন্য প্রার্থনা দুই-ই ব্যাক্ত হয় । অত্যন্ত দৃঢ় এবং গম্ভীরকণ্ঠে বাবা আদেশ করেন- “ না, এখান দিয়ে যেতে পারবে না ।”

বেশ কিছু সময় নির্বাহ হয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে শেষে শীতলা দেবী এক পা সামনে অগ্রসর হবার চেষ্টা করেন । ক্রোধান্বিত হন বাবা । বলেন- “ আমি এখানে আছি”- এই যেন অলঙ্ঘনীয় আদেশ । ভীত হয়ে নিজের জায়গায় ফিরিয়ে নেন তাঁর পা, বলেন, “তবে কি আমার এখানে আবদ্ধ থাকতে হবে, আমি কি যাওয়ার পথ পাব না?”

বাবা লোকনাথ বলেন, “ না, এখানে আবদ্ধ থাকতে হবে না, তবে উচ্চ ভূমির উপর দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না, ছাওয়ালবাঘিনী নদীর ঢালভূমি দিয়ে চলে যাও ।” আশ্রমের চতুর্দিকেই ঘন বসতি । একমাত্র ছাওয়ালবাঘিনীর ঢালভূমিতে কয়েকঘর মানুষ বাস করেন, তাই একরকম অনন্যোপায় হয়েই বাবা ঐ পথটি বেছে নেন ।

কয়েক দিনের মধ্যেই ঐ স্থানের বাসিন্দাদের মধ্যে কিছু লোক বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয় এবং তারা বাবার শরণাগতি নিলে বাবা তাদের ঐ স্থান ত্যাগপূর্বক প্রাণ বাঁচাতে নির্দেশ দেন ।

বাবা লোকনাথের বারদী আগমনের পূর্বে প্রতি বছর বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাবে বহু মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হত । কিন্তু এই ঘটনার পর হতে আর কোন দিন বারদীতে বসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়নি । যিনি পূর্ণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করে স্বয়ং ব্রহ্মময় হন তিনি যে পূর্ণব্রহ্ম ভগবান সমগ্র দেবকুল যে তাঁরই আদেশাধীন এই লীলার মাধ্যমে বাবা তাই প্রকাশ করেন । এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী বাবা লোকনাথকে যেদিন প্রথম দর্শন করলেন তখন তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখলেন বাবা লোকনাথের সর্ব অবয়বে দেব-দেবী বিরাজমান । কুটিরের মধ্যে অগণিত দেব-দেবীকেতিনি তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে দর্শন করে বাবা লোকনাথের পূর্ণভগবৎ স্বরূপের উপলব্ধি করেছিলেন । সকাম গৃহী ভক্তদের মধ্যে বাবা এ ভাব কৃপা করে দিন, তারা যেন বোঝে যে, যাঁর প্রতিটি লোমকূপে দেব-দেবীর বাস এক সেই পরমাত্মারূপী লোকনাথের সেবাপূজা করে তাঁরই ধ্যান করে তাঁকে প্রসন্ন করলে ইচ্ছামাত্র তিনি সর্ব অভীষ্ট পূরণ করবেন । তাঁর মধ্যেই সব । তিনিই পুরুষোত্তম, পরমপুরুষ ।

।।বারো ।।

একবার দুই বন্ধু বারদীতে বাবা লোকনাথের দর্শন মানসে রওনা হন । নারায়ণগঞ্জে এসে তারা স্থির করেন বাবার জন্য একটি কাঁঠাল সঙ্গে নেবেন । কিন্তু পথে ক্ষুধা নিবারণের জন্য তারা একটি নিজেদের জন্য এবং আরেকটি বাবার জন্য ক্রয় করেন ।

একটি বড় একটি ছোট । পথে ক্ষুধার উদ্রেক হতেই এক বন্ধুর দৃষ্টি পড়ে বড় কাঠালটির উপর । কিন্তু ইচ্ছা প্রকাশ করতেই দ্বিতীয় বন্ধু বলেন- আমরা বাবার জন্য কাঁঠাল কিনেছি, আমাদের উচিৎ বড় ফলটি তাঁর চরণে নিবেদন করা । কিন্তু প্রথম জনের এই যুক্তি মনঃপুত হয় না । তবুও শেষ পর্যন্ত বড় কাঁঠালটিই আশ্রমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ছোটটিকে দু’জনেই উদরস্ত করেন ।

আশ্রমে পৌছে কাঁঠালটি বাবার কাছে নিবেদন করতেই বাবা গোয়ালিনী মাকে ডেকে ওঠেন এবং বড় কাঁঠালটির প্রতি জার লোভ পড়েছিল তাকে দেখিয়ে বলেন, “ এই ছেলেটি যে কাঁঠালটি এনেছে তা ভেঙ্গে আন ।” গোয়ালিনী মা বাবার আদেশ মতন কাঁঠালটি ভেঙ্গে একটি পাত্রে রেখে বাবার কাছে নিবেদন করেন । বাবা নিজে খান না, ছেলেটিকে ডেকে বলেন, ‘খা’ ।

ছোটএকটিকথা- ‘খা’ কিন্তু এই একটি কথাতেই ছেলেটি অন্তরে অনুভব করে বিবেকের অসহনীয় দংশন । বাবা যে পথের সব খবরই জানেন, বুঝতে তার অসুবিধা হয় না । লজ্জায়, অনুতাপে সেকেঁদে ফেলে । বারবার বাবার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। স্নেহময়ী জননীর মতন পরম স্নেহ ভরাকণ্ঠে বলেন বাবা, “ তুই কাঁদছিস কেনরে? বড়টা যখন খেতে ইচ্ছা করল তখন ওটাই তোখাওয়া উচিৎ ছিল । আমার কাছে ছোট বড় সব সমান । একটা কথা কখনও ভুলিস না, যে জিনিসের উপর স্পৃহাজন্মে সেজিনিসে আশ্রমের সেবা হয় না”- ছেলেটি কেকাছেডা কেন বাবা; তাঁর করুণা হস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন এবং নিজের হাতে কাঁঠালের দুটি কোষ খাইয়ে দেন ।

এই লীলায় শিক্ষার বিষয় একটি, প্রভু ভক্তের দেওয়া কোনো বস্তুর ছোট বড় বাহ্যরূপের বিচার করেন না, তিনি ভাবের কাঙ্গাল ।

যে বস্তুর প্রতি লোভ হয় নিজের ভাগের ইচ্ছা হয়, তা দেবতা ভোগে কখনই দেওয়া উচিৎ নয় ।

।।তেরো।।

ঢাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীচন্দ্র কুমার দত্তের স্ত্রী বহুকাল যাবৎ নানান ব্যাধিতে মরণাপণ্য অবস্থায় পৌঁছান । স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বহুব্যয় করেও শারীরিক অবস্থা যখন দিনে দিনে অবনতির চরম সীমার দিকে যায়, তখন এক রকম হতাশ হয়েই ভাগ্য পরীক্ষার জন্য চন্দ্র কুমার মহাশয় স্ত্রীকে বাবা লোকনাথের কাছে নিয়ে যান এবং তাঁর কৃপা ভিক্ষা প্রার্থনা করেন । চন্দ্র কুমার বাবুকে বাবা লোকনাথ বলেন-

“ কোন সময়ে আমার মনে ইচ্ছা হয় যে, আমি মরা বাঁচাতে পারি কিনা দেখব । ইচ্ছা মাত্রেই আমার কাছে মৃত কল্প রোগীরা আসতে শুরু করে । এই সময়ে কেবল বাক্য দ্বারা ৯৪টি মৃতপ্রায় রোগীকে আরোগ্য করেছি । এখন আর সে ইচ্ছা হয় না, তবে আজও যদি কেউ আমার ইচ্ছা করে নিতে পারে তাহলে সে এখনও আরোগ্য হতে পারে। চন্দ্র কুমার বাবু মহাপুরুষের অলৌকিক শক্তির কথা শুনে বিস্মায়ান্বিত হয়ে ওঠেন এবং বলেন, “ইচ্ছা কিভাবে করিয়ে নেওয়া যাবে?”

উত্তরে বাবা বলেন,- “ ক্ষুণ্নিবারণের জন্য দেহের যেমন প্রয়োজন বোধ, বিষ্ঠামূত্র ত্যাগের জন্য দেহের যেমন প্রয়োজন বোধ, ঐরূপ প্রয়োজন বোধ যার আমার জন্য হয়, সে এখন ইচ্ছা করাইয়া নিতে পারে ।” কথাগুলো বাবা কেবল দেহের ব্যাধিমুক্তির জন্যই তার কৃপাশক্তি লাভের উপায় স্বরূপ বলেননি, একটু গভীরভাবে মনন করলেই ভক্তিশাস্ত্রের মূল ভাবটি এই কথাগুলোর মধ্য দিয়েই প্রকট হয় ।

তাঁর কৃপালাভ করার জন্য ভক্তি-শরণাগতিই যে উপায় এই কথাই বলেছেন বাবা লোকনাথ । আমরা যখন ক্ষুধার্ত হই- তখন ক্ষুধা নিবারণের চিন্তা বা আহার্য বস্তুর প্রতি মন আমাদের একাগ্র হয়, তেমনি মলমূত্র ত্যাগের প্রয়োজন যখন হয় তখন আমরা অন্য কোনো বিষয়েই মনটি দিতে পারি না । ভক্ত যখন লোকনাথ ব্যতিত আর কিছু ভাবতে পারে না, সুখে-দুঃখে যখন বাবাই একমাত্র সাথী, বাবার উপর সন্তানের সহজ অধিকারের মতন এক স্বাভাবিক অধিকার জন্মায়, তখন বাবার নিকটের জন- বাবা বলেছেন, তেমন ভক্ত আমার কাছে ব্যাকুল হয়ে যখন যা চায় আমি তখনই তা-ই দিই । তার কোনো চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখি না, কিন্তু আমার প্রতি ভালবাসায় যেন কোনো খাদ না থাকে । সংসারসক্ত সাধারণ জীব শত চেষ্টা করলেও তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ঈশ্বর প্রীতির ভাবকে প্রকৃত প্রেমে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয় না । জন্মান্তরের শুভ সংস্কারের ফলেই আমরা এমন ভক্তের সাক্ষাৎ সঙ্ঘলাভ করি যিনি বাবা কে কেবল বাবার জন্যই ভালোবাসেন, কোনো বিশেষ চাহিদা মেটাবার ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে নয় । তাঁকে ভালোবাসলে যে আনন্দ, যেশান্তি, তার কাছে আর কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে মনের মধ্যে উদয় হয় নাবলে, তিনিই প্রকৃত ভক্ত । বাবা যেমন ভক্তির জন্য সাধনা করতে বলেছেন, তেমন ভক্তির জন্য ব্যাকুল হতে বলেছেন । ভগবান তখন ভক্তের ইচ্ছার দাস ।

চন্দ্র কুমারের মৃতপ্রায় রুগ্নস্ত্রীর শীর্ণ শরীরের প্রতি দৃষ্টি পড়তেই বাবার অন্তরে করুণার উদয় হয় । তিনি তাকে ডাকেন, অবকণ্ঠিতা স্ত্রী সলজ্জভাবে বাবার চরণের কাছটিতে এগিয়ে আসেন, বাবা বলেন, “ তোর হাত বের কর।” অল্প একটু হাত বের করেন চন্দ্র কুমারের স্ত্রী । বাবা হাতটি বেশ জোর করে আরও বের করেন এবং নিজের পদ যুগল সম্মুখে প্রসারিত করেবলেন “ শক্ত করে ধর” ।

বাবার আদেশ পালন করেন চন্দ্র কুমারের স্ত্রী । বাবা চন্দ্র কুমারকে জিজ্ঞেস করেন- “ তুই কি তোর মাগকে আমার কাছে রেখে যেতে পারিস?” চন্দ্র কুমার বাবু কিছু দিনের মধ্যেই ঢাকা থেকে তাঁর স্ত্রীকে বাবার আশ্রমে পাঠিয়ে দেন। প্রায় দু’মাস যাবৎ বাবার চরণাশ্রয়ে থেকে গোয়ালিনী মায়ের সেবায় এবং বাবার অহেতুকী কৃপার ফলে তিনি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হন । চলৎশক্তিহীন অবস্থায় এসেছিলেন । বাবার কৃপাশ্রমে, আশ্রম ত্যাগের পূর্বে সুস্থ অবস্থায় বাবা তার হাতের পাক করা অন্ন খেয়ে তাকে আশীর্বাদ করে বিদায় করেন ।

চন্দ্রকুমার বাবু বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী রোগমুক্ত হলে তিনি তার এক মাসের বেতন ৫০০ টাকা আশ্রমের সেবায় নিবেদন করবেন । স্ত্রী সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরেন; কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার কথা তার মনে থাকে না । তিনি বরিশালে বদলি হন- বাবা লোকনাথ তাকে প্রতিশ্রুতি রক্ষার কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য পত্র লিখেন । উত্তর আসে, “আপনি সন্ন্যাসী ফকির, আপনি টাকা দিয়ে কি করবেন?” জীবন্মুক্ত মহাপুরুষের সঙ্গে এভাবেই কপট ব্যবহারের জন্য চন্দ্রকুমারের স্ত্রী এক বছরের মধ্যে আবার পূর্বের ন্যায় ব্যাধিগ্রস্ত হন ।

বাবার এই লীলার মাধ্যমে আমাদের এক বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করার আছে । চন্দ্রকুমার বাবু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই স্ত্রী আরোগ্য লাভ করলে ৫০০ টাকা আশ্রমে সেবায় দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন । বাবার কৃপায় অসম্ভব সম্ভব হয় । কিন্তু আমরা দেখি, বাবা লিখিতভাবে তাঁর কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করে দেওয়া সত্ত্বেও তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই বাবার আদেশ অমান্য করেন । তিনি ভুলে যান যে, বাবা তাঁর কাছে অর্থ চাননি । তিনিই দেবেন বলেছিলেন, বাবা কেবলমাত্র তাকে সত্যরক্ষা করার শিক্ষাটুকু দিতে চেয়েছেন ।

তাঁর অতিচালাকি এবং কপট ব্যবহারের জন্য আমরা দেখি তার পরিবার পুনরায় ব্যাধিগ্রস্ত হয় ।

কোনো বিশেষ বিগ্রহের কাছে বা কোনো মহাপুরুষের কাছে কিছু মানত করলে তা সময়মত রক্ষা অরা কর্তব্য । এর কারণ এই নয় যে, ভগবান ভক্তের অর্থ বা কোনো বিশেষ বস্তুর প্রত্যাশী, যিনি একমাত্র দাতা তিনি আবার কার দানের ভিখারী? কেবল ভক্তকে সত্যনিষ্ঠ শিক্ষা দেবার জন্য অকপটভাবে তাঁর সঙ্গে ব্যবহার করার জন্য ভগবান দেওয়া নেওয়ার লীলাটি করেন ।

ঢাকা জজ কোর্টের উকিল, শ্রীবিহারীলাল মুখোপাধ্যায় বাবার অনুগত ভক্ত । একবার তিনি জলপথে মেঘনা নদীর উপর দিয়ে স্টীমারযোগে আসাম যাচ্ছিলেন ।পথিমধ্যে হঠাৎ ভয়ঙ্কর দুর্যোগ শুরু হয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টীমারটা নিমজ্জিত হওয়ার উপক্রম হয় । বিহারীলাল মহাশয় এবং স্টীমারে অন্য যাত্রী সকল নিশ্চিত মৃত্যু আসন্ন জেনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকেন । হঠাৎ বিহারীলাল মহাশয়ের বাবার অভয়বাণী “রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও- আমিই রক্ষা করিব” কথাগুলো মনে পড়ে যায় ।

।।চৌদ্দ ।।

জীবনের সব থেকে সংকটময় মুহূর্তে বাবার কৃপাই একমাত্র ভরসা, সেই জ্ঞান করে অনন্যশরণ হয়ে তিনি বিপদে মধুসূদন লোকনাথের স্মরণ করতে থাকেন । বাবার শাশ্বত অভয়বাণী বৃথা যাবার কথা নয় । আর্ত হয়ে দীন হয়ে তাঁর শরণাগত হলে ভক্তবৎশল প্রভু ঠিক ভক্তকে রক্ষা করেন

।এক্ষেত্রেও অচিরে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে যায় । প্রকৃতির রুদ্র তাণ্ডব তাকে স্পর্শ করতে পারে না । অসম্ভবকে যিনি সম্ভব করতে পারেন সেই সর্বশক্তিমান ভগবান লোকনাথের কৃপায় বিহারীলালের ডাকে সবারই সেই যাত্রায় প্রাণ রক্ষা হয় । স্টীমারটি একটি মোচার খোলারমতই আন্দোলিত হচ্ছে এবং নিমজ্জিত হচ্ছে, ঠিক সেই সময় অনেক যাত্রী এক অদৃশ্য মহাপুরুষের অভয় হস্ত দর্শন করেন ।

ঢাকা জগন্নাথ কলেজের সুপারিডেন্ট শ্রী অনাথবন্ধু মৌলিক এই ঘটনা ঘটাকালে বাবা লোকনাথের শ্রীচরণের কাছে বসেছিলেন । হঠাৎ বাবা বলে উঠেন- “অনাথ, বিহারী বড়ই বিপন্ন, আমার কৃপা চাইছে, আমি তাকে রক্ষা অরতে চললাম”- কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার দেহটা নিস্পন্দ হয়ে আসনে উপবিষ্ট থাকে, তিনি সমাধিস্থ হন । কয়েক মুহূর্ত, বাবা তাঁর শরীরে ফিরে আসেন, বলেন, “মায়ার কি প্রভাব । বিহারীর জন্য একটু মায়াভিভূত হওয়াতে বিহারী কোথায় আছে, প্রথমবার ঠিক করতে পারিনি । প্রথমে ঢাকায় না পেয়ে তার বাড়িতে যাই । বিহারীর জন্য একটু মায়াভিভূত হওয়াতে বিহারী কোথায় আছে, প্রথমবার ঠিক করতে পারিনি । প্রথমে ঢাকায় না পেয়ে তার বাড়িতে যাই । বাড়িতে না পেয়ে জলপথে চট্টগ্রামের রাস্তায় তাকে পেলাম । তাকে আসন্ন মৃত্যর হাত থেকে রক্ষা করে এলাম । তার সঙ্গে অন্যান্য অনেক লোকও বেঁচে গেল ।” বেশ কিছুকাল অতিবাহিত হয়েছে, একদিন ভক্ত বিহারীলাল এসেছেন তাঁর প্রাণপ্রিয় বাবা লোকনাথের শ্রীচরণ দর্শনে । বিহারীকে দেখেই পূর্ব ঘটনা বাবার স্মরণ হয়, বাবা বলেন, “কি হে বিহারী, তুমি কি এর মধ্যে আমাকে স্মরণ করেছিলে?” বিহারীলালের কিন্তু স্টীমার দুর্ঘটনার দিনের কথা মনে আসে না, তাই সরল ভাবেই তিনি জবাব দেন- “বাড়িতে ফিরে এসে আপনার পাদপদ্ম দর্শন করার ইচ্ছা হয়েছিল বৈকি ।” বাবা মনে করি?” দেন তার প্রিয় সন্তানকে- “ তা নয় জল পথে বিপন্ন হয়ে কখনও মনে করেছিলে কি?”

মুহূর্তের মধ্যেই বিহারীর মানস পটে সেই ভয়াবহ দিনের কথা যুগপৎ ভেসে ওঠে, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে তাকে টেনে এনেছেন, সেই মহাশক্তিধর পরমেশ্বর যে তাঁরই সামনে স্থুলদেহ নিয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন । ভক্তি আপ্লুত চিত্তে বিহারী বাবার চরণ দুটি নিজের বক্ষের মধ্যে টেনে নেন এবং প্রভুর করুণার স্তুতি করতে থাকেন । উপস্তিত ভক্তদের কাছে বাবার শাশ্বত অভয় বানী, “রণে বনে জলে জঙ্গলে ............... রক্ষা করিব ।” সত্য মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন ।

।।পনের ।।

ঢাকা থেকে এসেছেন কয়েকজন ভক্ত, বাবার চরণ দর্শন করে তার সঙ্গলাভ করে মনে মনে অত্যন্ত আনন্দিত হন । ফেরার পথে পদব্রজেই ফিরে যাওয়ার কল্পনা করেন । কিন্তু পথে বেরোবার মুহূর্তেই সূর্যদেবের প্রখর তেজের দিকে তাকিয়ে বেশ দমে যান তারা, কারণ বারদী থেকে ঢাকা বেশ কয়েক মাইলের পথ । অন্তর্যামী বাবা এই শিক্ষিত ভক্তদের যোগে মহাশক্তির এক লীলা দর্শন করাতে চান । ডেকে পাঠান তাদের এবং বলেন, “ তোমরা চলে যাও, সূর্যের তাপে তোমাদের ভুগতে হবে না ।” বাবার কথায় মনে বল পেয়ে তারা পথে রওনা হয়ে যান এবং কিছুদূর যাওয়ার পর দেখেন যে একখণ্ড বড় মেঘ কোথা হতে এসে সূর্যকে ঢেকে ফেলে । এই আশ্চর্য ঘটনাটি বাবারই ইচ্ছায় সৃষ্ট একথা ভেবে একবার লীলাময় প্রভুর সম্মুখে তার সত্যতা সম্বন্ধে শোনার আশায় তারা আশ্রমে ফিরে আসেন এবং মনের সংশয়ের কথা অকপটে নিবেদন করেন, বলেন,

।।ষোল ।।

একদিন আশ্রমে এক বিশিষ্ট ভক্ত এসেছেন; কিন্তু এমন অসময়ে বাবার কুটিরের দ্বার রুদ্ধ কেন?

“ আপনার কথামতো একখণ্ড মেঘ সূর্যকে আচ্ছাদন করে আমাদের ছায়া দান করছে; কিন্তু তাতে আমাদের মনের সন্দেহ নিবারণ হয়নি, আমরা আপনার কাছে জানতে এসেছি যে, ঐ মেঘ খণ্ডটি আপনার ইচ্ছাতেই যদি ছায়া দান করতে এসেছে, তবে আমরা কোন স্থানে পৌঁছালে সূর্য আবার পূর্ববৎ তেজোস্মান হবে?”

বাবা বোঝেন ভৌতিক বিজ্ঞানের শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, মনের মধ্যেই যে বিরাট শক্তি লুকিয়ে আছে তার খবর রাখে না, বাবা দেখলেও বিশ্বাস করতে পারে না, তাই অধ্যাত্মবিজ্ঞানের অসীম শক্তির লীলা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চান । বলেন “তোরা ঢাকা শহরের প্রান্তবর্তী দয়াগঞ্জে পৌঁছালে পুনরায় রৌদ্র উঠবে ।”

ভক্তেরা বাবার চরণে প্রণাম নিবেদন করে রওনা হন স্বচোক্ষে দেখে বিশ্বাস করার জন্য যে মহাপুরুষের আদেশ পালন করার জন্য সমগ্র প্রকৃতি কিংকরীর মত অপেক্ষমান । মাইলের পর মাইল তারা হেঁটে চলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে বাবার আশীর্বাদ স্বরূপ মেঘখণ্ড তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে চলে, তারা যখন দয়াগঞ্জে পৌঁছান মেঘটি আপনা আপনি অপসৃত হতেই, সূর্যাদেব পূর্ণ প্রকাশিত হন আপনার তেজমহিমায় । আশ্রমের পিপীলিকারাও বাবার বিশেষ কৃপাভাজন । বাবার পরিবার জন । তাই প্রায়ই চিনি কিংবা মিশ্রির দানা ছড়িয়ে তাদের ডাকেন তিনি । যতক্ষণ না তারা সব কটি দানা নিয়ে তাদের বাসস্থানে চলে যায় ততক্ষণে তাদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন তিনি ।এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর কোনো আশ্রমবাসীই দিতে পারেনা । অন্তর্যামী ভগবান ভক্তের আগমন জানতে পেরে ভেতর থেকে বলে ওঠেন, “ওরে এখন ভেতরে আসিস না, আমার পরিবার আছে ।”

ভক্তটি কৌতুহল দমন করতে না পেরে উঁকি মেরে বাবার ঘরের ভেতরে দেখতে চেষ্টা করেন, কিন্তু একমাত্র আসনে উপবিষ্ট বাবাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যান, বাবার কথার অর্থ চিন্তা করেন । ইতোমধ্যে বাবা কুটিরের ভিতরে প্রবেশের আহ্বান করেন । ভক্তটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই কিন্তু তার সংশয় দূর হয় । বহুসংখ্যক পিপীলিকার এক লম্বা লাইন তখন বীরবিক্রমে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের মুখে চিনির দানা । বুঝতে পারে সে বাবার আদেশের মর্মার্থ, ঐ সময় ঘরে প্রবেশ করলসে অসাবধানতার ফলে হয়ত পদদলিত হয়ে অনেক পিপীলিকার প্রাণ হত্যা হত, তাই দয়াময় ভগবান বলেছেন- “ভেতরে আসিস না, আমার পরিবার আছে ।” প্রসংক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, আগত ভক্ত বারদীর জমিদার শ্রী অরুণকান্ত নাগ মহাশয় । বলতে দ্বিধা নেই যে, আজকালকার আশ্রমে মঠে সাধু বাবারা ধনী, শেঠ এবং মন্ত্রীদের আগমনে নিজেদের বিশেষ ধন্য মনে করেন এবং তাদের সেবা এবং সম্মান প্রদর্শনের জন্য সাধারণের থেকে সর্বদা আলাদা ব্যবস্থাই করে থাকেন । কিন্তু সমদৃষ্টির মূর্তবিগ্রহ বাবা লোকনাথ কেবল গৃহীদের সর্বজীবে দয়া এবং প্রেম শিক্ষা দিলেন না, সেই সঙ্গে সাধুদের সমদর্শনের আদর্শ শিক্ষা দিচ্ছেন । তাঁর উদার করুণা দৃষ্টিতে পিপীলিকার স্থান জমিদারের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়, যখন জমিদারকেও কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করতে হয় ।

।।সতের ।।

ইতর প্রাণীর প্রতি বাবা লোকনাথের অসীম করুণার একটি সুন্দর লীলা কাহিনীর কথা আমরা শুনি- একবার একটি ব্যাধিগ্রস্ত কুকুর অসহনীয় যন্ত্রনায় কাতর হয়ে বাবার কুটিরের পাশে আশ্রয় নেয় ।

আশ্রমের মা-গোয়ালিনী মায়ের চোখে পড়ে এই দৃশ্য, লোকনাথের সান্নিধ্যে থেকে তাঁর মধ্যেও জেগেছে সর্ব্জীবে দয়ার ভাব । কুকুরটির ব্যথায় ছটফট করতে দেখে তাঁর মাতৃহৃদয় ব্যথিত হয়, ছুটে যান তিনি বাবার কাছে, নিবেদন করে অন্তরের ব্যাকুল প্রার্থনা- “ তোমার কৃপায় কত লোকই কত দুঃসহ যন্ত্রণা এবং দুরারোগ্য ব্যাধির হাত থেকে রেহাই পেল, এই আশ্রমে আগত কোনো শরণাগতকেই তো তুমি তোমার কৃপায় ছায়া বঞ্চিত করনি, তবে এই কুকুরটির প্রতি তোমার কৃপা দৃষ্টি হবে না?” গোয়ালিনী মায়ের মধ্যেই সমদর্শন এবং জীবে দয়ার ভাব লক্ষ্য করে মঙ্গলময় গুরু লোকনাথ অত্যন্ত প্রসন্ন হন । শরণাগত ভক্তকে এভাবেই তিনি সূহ্মভাবে অন্তর্জগতে কৃপাস্পর্শের মাধ্যমে কত পরিবর্তন সংঘটন করে, ভক্ত বোঝেও না । মায়ের কথাটুকু শোনামাত্র বাবার হৃদয় দয়াদ্র হয়, তিনি তাঁর আসন ছেড়ে তৎক্ষণাৎ উঠে আসেন, মায়ের সঙ্গে মুমূর্ষু কুকুরটির কাছে যান, চলৎশক্তি রহিত অবস্থায় কুকুরটি ভ্রুযুগলের কেন্দ্রস্থলে স্পর্শ করেন- মুহূর্তের মধ্যে কুকুরটির সব যন্ত্রণার অবসান হয়, বাবার কৃপায় নবজন্ম হয় তার ।

।।আঠারো।।

আশ্রমেরকোনোজীবইবাবারকৃপায়অভুক্ত থাকত না । একবার এক ভক্ত বাবার আহারের জন্য এক বাটি ঘন দুধ এনে তাঁর চরণে নিবেদন করেন । দুধটি দেখেই কিন্তু বাবার এক সন্তানের কথা মনে হয়, তিনি তখনই আয়, আয় বলে ডাকতে থাকেন জনৈক ভক্ত সাম্নেই বসে ছিল । বাবাকে ঐভাবে ডাকতে দেখে সে বেশ আশ্চর্য হয়ে যায়, কারণ নিকটে কোনো মনুষ্য চরিত্র তো দেখা যায় না ।কিন্তু কয়েক মুহূর্তের পরই যে দৃশ্য সে দেখে, তাতে তার শরীর ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায়- এক প্রকাণ্ড কাল কেউটে বাবার কাছে ছুটে আসে,

বাবা সন্তানের মতন তাঁর আদেশের অপেক্ষায় থাকে । বাবা সাপটির ফণা ধরে দুধের বাটির মধ্যে প্রবিষ্ট করেন। সাপটি মহানন্দে দুধ খেতে থাকে । খাওয়া শেষ হতে সে ফণা উঠিয়ে আনলে বাবা বলেন- “এখন চলে যাও ।” তৃপ্ত সাপটি বাবার আদেশ শিরোধার্য করে নিজের ডেরায় ফিরে যায় ।

এমন বিষাক্ত কাল কেউটের সঙ্গে যেকোনো মানুষের এমন প্রেমের সম্বন্ধ সম্ভব এই যেন সপ্নেরও অতীত । তাই বিস্ময় অভিভুত ভক্তটি নির্নিমেষ নয়নে বাবার দিকে চেয়ে থাকে । পাত্র থেকে কিছুটা সর বাবা নিজে মুখে নেন এবং অবশিষ্ট অংশ ভক্তটিকে দিয়ে বলেন, “ নে প্রসাদ নে ।” বিষাক্ত সাপের মুখের দুধ যে আবার প্রসাদ হতে পারে এই যেন আরও আশ্চর্যজনক বলে মনে হয় তার কাছে । ভয় পায় সে, অন্তর্যামী ভগবান বোঝেন ভক্তের মনের কথা । বলেন, “ ওরে আমি যখন হাতে তুলে দিচ্ছি তখন আবার ভয় কিসের ।” লজ্জিত হয়ে ভক্তটি হাত বাড়িয়ে প্রসাদ গ্রহণ করে । আশ্রমের প্রতিটি জীবের প্রতি বাবার দয়া এবং করুণার এক অপরূপ লীলার সাক্ষী হয়ে থাকে সে ।

।।উনিশ ।।

একবার ব্রাহ্মসমাজের দুই যুবক বাবা লোকনাথের বহুল প্রচার এবং বাবার বারদী আগমনে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি জনসমাজের প্রতি অনাস্থার ফলে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে রাতের অন্ধকারে মেরে তাড়াবার পরিকল্পনা করে হাতে লাঠি নিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করে । আশ্রমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তাদের । এক ভীষণ আকারের বাঘ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন তাদের সামনে গর্জন করে উপস্থিত হয় । এমন অবস্থায় সম্মুখীন হতে হবে তারা ভাবতেও পারেনি, তাই প্রাণ ভয়ে ভীত হয়ে নিকটেই একটা কুটিরের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে প্রাণরক্ষা করে তারা ।

ঠিক এই সময় বাবা লোকনাথ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন । বন্ধ দুয়ারের ছিদ্র পথ দিয়ে যুবকেরা বাবাকে বাইরে আসতে দেখে মনে মনে বেশ খুশিই হয় । মনে মনে ভাবে ভণ্ড তপস্বীর শেষযাত্রা হয়ত বাঘের পেটেই হবে; কিন্তু চোখের সামনে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা দর্শন করে তারা বিশ্ময়ে হতবাক হয়ে যায় । বাবাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাঘটি তার সব হিংস্র ভাব ভুলে গিয়ে অনুগত দাসের মত তাঁর চরণে লুটিয়ে পড়ে । বাবাও পরমাদরে বাঘটির গায়ে মাথায় তাঁর মত শ্রীহস্ত বুলিয়ে দেন, বলেন, “মা তুই এখানে কেন এসেছিস? এখানে আশ্রমে কত লোকজন আসে, তুই জঙ্গলে চলে যা, সেখানেই আহার পাবি ।” বাবার মুখের কথা শেষ হয় না । বাঘিনী সেই মুহূর্তেই বাবার আদেশ পালন করে রাতের অন্ধকারে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় । এই অলৌকিক লীলা দর্শন করে যুবক দুটির বুঝতে বাকি থাকে না যে, বাবা কোন অবস্থায় বিরাজ করছেন ।

।। কুড়ি ।।

রাধিকা মোহন রায় সব সময় চিকিৎসা সত্ত্বেও বাত ব্যাধিতে পঙ্গু হয়ে যান । তাঁর স্ত্রী স্বামীর রোগমুক্তির জন্য সব চেষ্টায় বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত সাধু মহাপুরুষের কৃপাই একমাত্র উপায় নিশ্চিত করেন । শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মুখে বাবার মহিমার কথা শুনে তাঁর কাছেই শরণাগতি নেবার জন্য তাঁরা সপরিবারে বাবার আশ্রমে পৌঁছান ।রাধিকা মোহন চরিত্রহীন ছিলেন । ঘরে সতী-সাধ্বী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় পরায়ণগতবশতঃ তিনি যথেচ্ছ জীবন যাপন করতে থাকেন এবং পরিশেষে কর্মদোষে পঙ্গু হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হন ।এমন পাপীষ্ঠ মানুষের কষ্টে তাই বাবার হৃদয়ে কোনো দয়ার ভাব উদয় হয় না । কিন্তু রাধিকার স্ত্রীর পবিত্রতা এবং বাবার চরণে ঐকান্তিক নিষ্ঠার ভাব দেখে বাবা মুগ্ধ হন, তাই সতীর পুণ্যে পতির পুণ্যরূপ প্রবাদ শাশ্বত সত্যে প্রতিপন্ন হয় বাবার আচরণের মাধ্যমে ।

স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে চরিত্রহীন স্বামীর পাপকেও ক্ষমা করতে হয় দয়াময় প্রভুকে ।

একদিন রাধিকার স্ত্রী বাবার কাছটিতে অধোবদনে বসে আছেন । চোখে-মুখে তাঁর ক্লিষ্ট ভাব । স্বামী বাবার কৃপায় সুস্থ হয়েও কেন সুস্থ হচ্ছে না, এই চিন্তাই তাকে ম্লান করে তুলেছে । বাবা বুঝতে পারেন ভক্তিমতী নারীর অন্তরের কথা । তবু জিজ্ঞেস করেন, “ তুই এমন করে বসে আছিস কেন রে? তোর স্বামী তো ভালই হয়ে এসেছে ।” রাধিকার স্ত্রী বাবার প্রশ্নের উত্তর অতি বিনীতভাবে করজোড়ে নিবেদন করেন বাবা, আপনার কৃপায় উনি প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন; কিন্তু হাতটাতো আজও ওঠাতে পারছেন না । আমার বিশ্বাস আপনার কৃপা ছাড়া আমাদের আর গতি নেই । আপনি কৃপা করুণ । কথাগুলো শুনে বাবার হৃদয়ে করুণাদ্র হয়, তিনি তৎক্ষণাৎ রাধিকার যে হাতটি পঙ্গু হয়ে আছে, নিজেই সেই হাতটি তিনবার শূণ্যে উত্তোলন করেন এবং বলেন, “যা গিয়ে দেখ হাত উঠেছে ।”

এই কথাগুলো শোনার জন্যেই তিনি যেন ভগবানের চরণে শরণ নিয়ে একনিষ্ঠ হয়ে বসেছিলেন । এতদিনে বাবার বহুবিধ অলৌকিক লীলা দর্শন এবং তাঁর মনে পূর্ণ বিশ্বাস জন্মেছিল যে, মহাপুরুষের বাক্য অমোঘ এবং তাঁর ইচ্ছা মাত্রেই অসাধ্য সাধন সম্ভব । তাই মহানন্দে তিনি ছুটে যান নৌকায় । দেখেন সেই অবশ হাত প্রভুর কৃপায় স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করেছে- তার স্বামী সম্পূর্ণ রোগ মুক্ত হয়েছেন । তার এতোদিনের সাধনার ফল দর্শন করে তিনি নিজেই অভিভূত হন । মহাপুরুষের কৃপাই জীবনের একমাত্র পাথেয় করে তিনি সুস্থ স্বামীকে নিয়ে গৃহে ফিরে যান ।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মবিদ-বলিষ্ঠ মহাযোগী । তাঁর অসামান্য শক্তির প্রভাব কেবল প্রাণী এবং মনুষ্য জগতের উপরই নয়, সমগ্র দেবলোকের উপর সমানভাবে বিস্তৃত । কেবল শরণাগত মানুষই নয়, দেব-দেবীও তাঁর অনুগত লাভের জন্য লালায়িত । দেব্লোকের উপর তার প্রভাব ক্ষমতা আমরা দর্শন করি বারদীর আশ্রমে, শীতলা দেবীর আগমন প্রসঙ্গে ।

।।একুশ ।।

প্রভুপাদ শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বিশেষভাবে বাবার স্নেহভাজন এবং কৃপা অধিকারী ছিলেন । একবার দ্বারভাঙ্গায় থাকাকালীন তিনি উৎকট ব্যাধিতে মরণাপন্ন হন । তাঁর আত্মীয় এবং শীষ্য ভক্তজন তাঁর প্রাণরক্ষা করার জন্য সব রকম প্রচেষ্টা করেন, চিকিৎসকগণের সব চেষ্টা বিফল হয় ।

গুরুগতপ্রাণ শ্যামাচরণ বকশী বিজয়কৃষ্ণজীর শিষ্য ছিলেন । গুরুদেবের জীবন সংকটাপন্ন, ঢাকায় এই খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কালবিলম্ব না করে বাবা লোকনাথের কাছে উপস্থিত হন । বিজয়কৃষ্ণ যে বাবার অতি প্রিয়জন এই কথা শ্যামাচরণ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন, তাই গুরুর গুরু জগদ্গুরু লোকনাথের শরণাগতি নেন ।

গুরুভক্ত শিষ্যদের প্রতি বাবার বিশেষ কৃপা দৃষ্টি; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই লীলাময় প্রভু শিষ্যের গুরুভক্তির পরীক্ষা নিতে চান । এক্ষেত্রেও বাবা শ্যামাচরণের গুরুভক্তির পরীক্ষা নেন- বলেন, “তুই তোর গুরুর জন্য কি স্বার্থত্যাগ করতে পারিস?” শ্যামাচরণ গুরুকে প্রাণাধিক বেশি ভালোবাসতেন, তাই সঙ্গে সঙ্গে অকপটভাবে জবাব দেন, - আমি আমার গুরুর জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে পারি ।

আপনি আমার অর্ধেক আয়ু নিয়ে আমার গুরুদেবের প্রাণ রক্ষা করুন । আপনি ব্যতীত কেউই এই সংকটে তাঁকে রক্ষা করতে পারবে না ।

গুরুনিষ্ঠা এবং ভক্তির এমন সুন্দর উদাহরণ দর্শন করে বাবা প্রশন্ন হন । বলেন, “ যা তুই ঘরে গিয়ে খেয়ে আয় ।” কিন্তু গুরুর প্রাণ সংকটাপন্ন, এমতবস্থায় আহারের চিন্তাও করতে পারেনা না তিনি । বলেন, গুরুর প্রাণ রক্ষা না হওয়া পর্যন্ত আমার পক্ষে মুখে এক গ্রাস অন্নও দেওয়া অসম্ভব । তবে আপনি যদি বলেন যে, আমার গুরুদেবের প্রাণ রক্ষা করেছেন তবেই আমি অন্নগ্রহণ করব । অন্তর্যামী ভগবান দৃড়ভাবে উত্তর দেন, “ আমি বলেছি তোর গুরু সুস্থ হয়েছে, তুই খেয়ে আয় ।” বাকসিদ্ধ মহাযোগীর কথার অমোঘ শক্তিতে বিশ্বাসী শ্যামাচরণ মহানন্দে ঘরে যান আহার গ্রহণ করার জন্য ।

বাবা লোকনাথের কৃপায় বিজয়কৃষ্ণজীর দ্বিতীয়বার প্রাণ রক্ষা হয় । একবার চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দাবানলের সংকটময় মুহূর্তে, দ্বিতীয়বার দ্বারভাঙ্গায় । হৃত স্বাস্থ্য উদ্ধারের পর বিজয়কৃষ্ণজী ঢাকায় আসার পর ভক্ত শিষ্যের কাছে বাবা লোকনাথের করিণার কথা ব্যক্ত করে বলেন, “বাবা লোকনাথ দ্বারভাঙ্গায় আমার মৃত্যুশয্যায় হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর কৃপায় আমার প্রাণরক্ষা হয়েছে ।” বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর নিকট আত্মীয়জন যাঁরা গোসবামীজীর মৃত্যুসয্যার পাশে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা স্পষ্ট দেখতে পান ব্রহ্মচারী বাবা (লোকনাথ) বিজয়কৃষ্ণজীর মাথার কাছে বসে আছেন এবং নিজ হাত ধরে গোস্বামী তিনবার শয্যা হতে ঊঠে বসার চেষ্টা করেন আবার অচৈতন্য হন এবং তৃতীয়বার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে বসেন । এই লীলার রহস্য সত্যিই অচিন্তিনীয় । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর আত্মা দেহত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছে, বাবা লোকনাথ, ইচ্ছাময় প্রভু , সেই আত্মাকে স্বইচ্ছায় বিজয়কৃষ্ণজীর দেহে প্রবিষ্ট করিয়েছেন ।

কিন্তু অসহনীয় যন্ত্রনায় কাতর বিজয়কৃষ্ণজীর আত্মা যখন আবার দেহত্যাগ করে বেরিয়ে আসে বাবা তাকে শরীরে পুনঃপ্রবিষ্ট করেন । এভাবে তিনবার বিজয়কৃষ্ণজীর শরীরে তাঁর আত্মাকে প্রবিষ্ট করিয়ে তাঁর প্রাণ রক্ষা করেন । বাবা লোকনাথের এই লীলাটি তাঁর অচিন্তিনীয় যোগশক্তির পরিচয় দেয় ।

শ্যামাচরণের গুরুভক্তিতে প্রসন্ন বাবা লোকনাথ সূক্ষ্মদেহে তাঁর প্রিয় জীবনকৃষ্ণের প্রাণ রক্ষা করে গুরুভক্তির এবং গুরুভক্ত শিষ্যের প্রতি ঈশ্বরের করুণার এক জ্বলন্ত উদাহরণ সৃষ্ট করেন ।

।।বাইশ ।।

একবার জনৈক ভক্ত তাঁর বৃদ্ধা মাতা এবং স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাবার চরণ দর্শনে আসেন । এবং বাবার কাছে তাদের মনস্কামনার কথা ব্যক্ত করেন । বধূটি ইতিপূর্বে কয়েকবার মৃত সন্তান প্রসব করে । বধূটি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বাবার আশীর্বাদ এবং কৃপাভিক্ষা করার জন্য আসে । তার বিশ্বাস, বাবা কৃপা করলে সে সন্তানের জননী হবার সৌভাগ্য লাভ করবে । বধূটির সরলতা এবং ভক্তি বিশ্বাস দেখে বাবা প্রশন্ন হন । তিনি শাশুড়ীর প্রতি লক্ষ করে বলেন, “বধূর প্রসব হতে আর যতদিন বাকি আছে, তার প্রত্যেকদিন এক এক পয়সা গোঁসাইয়ের (বাবার) ভোগের জন্য রেখে দিও । প্রসব হয়ে গেলে ঐ পয়সা আশ্রমে পাঠিয়ে দিও । তা হলে আর সন্তান মরবে না ।”

বাবার আদেশে তারা প্রত্যহ এক পয়সা করে সঞ্চয় করে রাখে এবং কালে তারা একটি কন্যা সন্তান লাভ করেন । কন্যাটি বাবার আশীর্বাদে সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী হয় । তারা সঞ্চিত পয়সা এবং সন্তানসহ বাবার চরণ দর্শন করেন এবং বাবার আশীর্বাদ লাভ করে ধন্য হন ।

।।তেইশ ।।

বাবা ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন, এমন সময় এক ব্যক্তি এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করেন এবং বাবার কৃপার জন্য প্রার্থনা করেন । ব্যক্তিটির ব্যবহারে উপস্থিত ভক্তরা বেশ আনন্দিত হন, কারণ তিনি ভক্তি গদগদ চিত্তে বাবার আদেশের জন্য অতি আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করেন । কিন্তু অন্তর্যামী লোকনাথ এত সহজে কেবল বাহ্যিক আচরণ দেখে ভোলার পাত্র নন । বেশ রুক্ষ্মভাবে বলেন,- “তুই তোর মাগকে ভালবাসতে পারিস না, আমাকে ভালোবাসবি কেমন করে?” কথা কয়টি উচ্চারণ করেই বাবা ব্যক্তিটির দিকে আর দৃষ্টিপাত করেন না । বাবার এমন ব্যবহারে লোকটি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে এবং স্থানত্যাগই একমাত্র উপায় ভেবে নিঃশব্দে চলে যায় । ভক্তরা পরে খবর নিয়ে জানতে পারেন যে, আগত ব্যক্তি সত্যিই তার সতীসাধ্বী ভক্তিমতী স্ত্রীকে বিনা কারণে পীড়ন করে ।

কথা কয়টি যদিও এক বিশেষ ব্যক্তিকে লক্ষ করেই বাবা বলেন, তথাপি এই গুরুবাক্যের সত্যতা বেশিরভাগ মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে সত্য । যে আপনজনকেই ভালবাসতে শিখল না, সে আবার ভগবাঙ্কে ভালোবাসবে কেমন করে? বাবা বলেছেন, - ঘরের ভগবাঙ্কে ঘৃণা করে লাঞ্ছনা করে কেউ যদি ভগবান লাভ করার বাসনা করে তা কখনই সম্ভব নয় । তাঁর কৃপা পেতে গেলে ভালবাসতে হবে, আর তাঁকে ভালোবাসা মানে এই নয় যে পরিবার বা সমাজের আর পাঁচজনকে অবজ্ঞা করতে হবে ।

যাকে পাওয়ার জন্য এত ভক্তি, এত যোগ তিনি কি কেবল মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহের মধ্যে কিংবা সাধু মহাপুরুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? তিনি যে সবার মধ্যে ‘সর্বভূতাত্মা’ ।

বাবা বলেছেন তাঁকে ভালবাসতে গেলে আগে ঘরেই শুরু কর । মাতা-পিতা, স্ত্রী-পুত্র সবার মধ্যেই যে তিনি । সবাইকে আপন করতে পারে না যে, নিঃস্বার্থভাবে সবার জন্য যার প্রাণ কাঁদে না, সে আবার বিরাটকে ভালোবাসবে কি করে? তাঁকে ভালবাসতে গেলে চাই সংকীর্ণতা থেকে বিস্তারের দিকে গতি । যে হৃদয় প্রাণী মাত্রের দুঃখে নিজের অন্তরে দুঃখ অনুভব করে, সবার আনন্দেই যার আনন্দ, সেই তো ভক্ত, সেই তো ভগবানের সব থেকে প্রিয়জন । সবার মধ্যেই ‘মা’- সবার মধ্যে ইষ্ট, এই সত্য প্রতিষ্ঠার সাধনাই সাধক্কে ইষ্টময় করে তোলে, গুরুকৃপা এমন আধারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝরে পড়ে । তাই তো বাবা বললেন, “ওরে কাছের ভগবানের উপেক্ষা করে, উৎপীড়ন করে, কোন দূরের ভগবানক খোঁজ নিতে আমার কাছে এসেছিস?”

।।চব্বিশ ।।

রাজামোহন চক্রবর্তী মহাশয় ধর্ম অনুশীলন করতে ঠিক বিচারে পথ ভুলে বিপর্যয় জ্ঞানে মোহগ্রস্ত হয়ে সত্য ভ্রষ্ট হন । আমার মধ্যে ভগবান আছেন সুতরাং আমিই ভগবান, একথা কেবল মুখে বলেন না, গৃহে সংরক্ষিত নারায়ণের শিলাকে কেবল একখণ্ড শিলা জ্ঞান করে তার উপর নিজের পা তুলে দেন ।

ইতিপূর্বে যারা তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তারা এরূপ ব্যবহারে দিনে দিনে বীতশ্রদ্ধ হন এবং গৃহের আত্মীয়স্বজনও তাকে উন্মাদগ্রস্ত মনে করতে থাকেন । চক্রবর্তী মহাশয়ের স্ত্রী অতিশয় ভক্তিমতী । তিনি স্বামীর এইরূপ ব্যবহারে এক চরম সমস্যার সম্মুখীন হন এবং এই সংকট হতে মুক্তির আশায় স্বামীকে নিয়ে বারদীর আশ্রমে উপস্থিত হন । অন্তর্যামী ভগবান লোকনাথকে অন্তরের কথা নিবেদন করতে হয় না, স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি চক্রবর্তী মহাশয়কে কাছে ডেকে তাঁকে স্নেহমাখা কণ্ঠে তিরস্কার করেন ।

“আমার কাছে তো কত লোকই আসে, কত রকম ফল পায়, কিন্তু আমি তো তোর মতন নিজেকে ঈশ্বর বলে প্রকাশ করি না এবং শাল্গ্রাম চক্রের উপর পা দিয়ে সমাজের লোকদের মনের কষ্টের কারণ হই না । এমন আচরণ কোনোমতেই সঙ্গত নয়, ভবিষ্যতে এমন আচরণ আর কখনও করবি না ।” আশ্চর্য হন চক্রবর্তী মহাশয়, তার ব্যবহারের সব কথাই মহাপুরুষ বারদীতে বসেই অবগত আছেন । কথাগুলোর যুক্তি এবং আদেশ দুই-ই তার কাছে অবশ্য পালনীয় বলে মনে হয় । সেই থেকে তিনি নিজেকে সংযত করে নেন এবং বিপর্যয় জ্ঞেনের হাত থেকে মুক্তিলাভ করে প্রকৃত সত্য লাভের জন্য সচেষ্ট হন ।

যারা প্রকৃত সত্য লাভ করতে চান, দিব্য আনন্দের ছোঁয়া পেতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে বাবা বলেছেন- “ধার্মিক হতে চাইলে প্রতিদিন রাত্রে শয়নকালে প্রতিদিনের কর্মের হিসাব নিকাশ করবি, অর্থাৎ ভালো কর্ম কি করেছিস এবং মন্দ কর্ম কি করেছিস, তা চিন্তা করে মন্দ কর্ম যাতে আর করতে না হয় তার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবি ।”

।।পঁচিশ ।।

লোকনাথ একাই চলেছেন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের জংলের মধ্য দিয়ে, হঠাৎ দেখেন জংলের চতুর্দিকে অগ্নিদেবের মহাতাণ্ডব । দাবানলের লেলিহান শিখা যেন আকাশকে চুম্বন করার জন্য ঊর্ধ্বে উঠেছে, পশু-পক্ষী ভীত আর্ত হয়ে ছুটছে প্রাণের তাগিদে । পশু-পক্ষীর আর্ত গর্জন এবং কলরবে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখেন লোকনাথ ।

প্রভুপাদ শ্রী শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী এই সময়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের এক বৃক্ষের তলায় আসন করে ধ্যানে রয়েছেন নিমগ্ন ।

হঠাৎ গগনভেদী আর্তনাদ এবংকলরবেতাঁরধ্যানেরধারায়ছেদটেনেদেয়, চোখ খুলে দেখেন চতুর্দিকে অগ্নির লেলিহান শিখা যেন এক প্রাচীরের আকার ধারণ করে তাঁকে আত্মসাৎ করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে অগ্রসর হচ্ছে । এই সংকটময় মুহূর্তে কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করে তাঁর মনে এতটুকু ভয়ের উদয় হয় না, যাকে তিনি রক্ষা করেন, তাঁকে মারে কার সাধ্য, য়ার যাকে তিনি মারেন তাঁকে রাখে কার সাধ্য, এই কেবল কথার কথা নয়, এই যে তাঁর অন্তরের উপলব্ধি, প্রভুর এই ভক্তকে রক্ষা করার ভাবটির পরিচয় যে তিনি অনেক অনেক ভাবেই দর্শন করেছেন, তাই একাগ্রচিত্ত হয়ে তিনি মধুসূদনকে স্মরণ করেন- বিপদে যে তিনিই রক্ষা করেন ভক্তকে, তাঁর শরণাগতকে ।

‘নে মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি’- আমার ভক্তের বিনাশ নেই । হঠাৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী দেখেন এক অদ্ভুত দৃশ্য- অগ্নির লেলিহান শিখার মধ্য দিয়ে এক জটাজুটমণ্ডিত দীর্ঘদেহী । শিবকল্প দিগম্বর সন্ন্যাসী এগিয়ে আসছেন তাঁরই দিকে দুটি আজানুলম্বিত হস্ত প্রসারিত করে । মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর ভারি শরীরটি অবলীলায় যোগী তুলে নেন নিজের কোলে, ছোট শীশুর মতন বসিয়ে নেন তাঁর স্কন্ধের উপর এবং যে পথে এসেছিলেন সে পথেই আবার রওনা হন । কিন্তু কি অলৌকিক এই লীলা, বিজয়কৃষ্ণজী দেখছেন অগ্নির মধ্য দিয়ে যোগী চলছেন, অগ্নির শিখাও তাঁর অঙ্গে লাগছে; কিন্তু অগ্নির তাপ নেই, কেবল এক শীতল স্পর্শ যেন তিনি অনুভব করেন সর্বাঙ্গে । তারপর আর তিনি কিছু মনে করতে পারেন না । যখন সম্বিৎ ফিরে পান তখন দেখেন পাহাড়ের এক অতি সুরক্ষিত স্থানে তিনি শয়ন করে আছেন । সমস্ত ঘটনাই যেন তাঁর কাছে এক অদ্ভুত সপ্নদর্শন বলে মনে হয় । বোঝেন প্রভুই তাঁকে কৃপা করে সন্ন্যাসী রূপ ধারণ করে রক্ষা করলেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে । অন্তরের সবটুকু প্রেম তিনি ঢেলে দেন অপরিচিত ঐ সন্ন্যাসীর রূপ্টি মানস নয়নে কল্পনা করে তাঁর চরণে ।

পরবর্তীকালে বারদীর মহাতীর্থে যখন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী দর্শন করতে যান বাবাকে, বাবা তাঁকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দাবানলের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং

জিজ্ঞেস করেন কে তাঁকে অইদিন রক্ষা মুহূর্তেই মানসপটে ঐ ভয়াবহ দিন্টির কথা ভেসে ওঠে এবং ভগবৎ প্রেরিত মহাপুরুষের যে রূপটি দেখতে পান সে যা তাঁরই সামনে সশরীরে বসে আছেন তাঁর বড় আপনজনটি সেজে । মৌন কৃতজ্ঞতায় বিজয়কৃষ্ণজীর অন্তর-জগৎ প্লাবিত হয়, বাবার চরণ দুটি ভক্তিভরে তিনি নিজের বক্ষের মধ্যে টেনে নেন, মস্তকে নেন পুণ্যস্পর্শে । বাবার অসাধারণ যোগবিভূতি এবং করুণার পরিচয় লাভ করে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী বাবার এক অনুগত ভক্তরূপে প্রকাশিত হন এবং তাঁর অগণিত ভক্তের কাছে ঢাকা এবং বাংলাদেশের নানান স্থানে ধর্ম প্রচারের সময় বাবার অসামান্য যোগশক্তির কথা প্রচার করেন ।তাঁরই প্রচারের ফলে, কালে বহু দূরদূরান্ত হতে বহু নরনারী এসে উপস্থিত হন বারদীর পুণ্যভূমিতে, ধন্য হন বাবার কৃপাপ্রসাদ লাভ করে । বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজী তাঁর শিষ্যদের কাছে বলেন, তাঁর তীর্থ দর্শনের এক অভিজ্ঞতার কথা । একবার উত্তর ভারতের বহু তীর্থ দর্শন করে তিনি হিমালয়ের দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে অতিক্ক্রম করে পৌঁছান মানস সরোবরের ঊর্ধ্বে এক তুষারবৃত সাধন পীঠে । সে স্থান সাধারণের অগম্য । সেখানে পৌঁছে তিনি দর্শন করেন প্রাচীন শরীরধারী দীর্ঘজটাজুটমণ্ডিত কয়েকজন সমাধিস্থ যোগী পুরুষকে । প্রথম দর্শনেই বুঝতে অসুবিধা হয় না বিজয়কৃষ্ণজীর যে বহু যুগ ধরে এই মহাপুরুষগণ এ স্থানে সমাধির উচ্চ অবস্থায় মগ্ন হয়ে আছেন । সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করেন তিনি সকলের উদ্দেশ্যে, কৃপা পরবশ হয়ে একজন তাঁর সমাধির জগৎ থেকে নেমে আসে, স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন বিজয়কৃষ্ণজীর প্রতি, বলেন, “বেটা, তুই এত কষ্ট করে এত দুর্গম পথে কেন এখানে এসেছিলে, তোর ঘরের পাশেই যে বিরাজ করছেন এক মহাপুরুষ যিনি আমাদের থেকেও অনেক উন্নত, উচ্চ অবস্থা লাভ করে তোদের জন্য নিম্নভূমিতে গেছেন ।”

বিজয়কৃষ্ণজী সেই সময় বাবা লোকনাথের বারদীতে অবস্থানের কথা জানতেন না,

পরবর্তীকালে যখন বাবা লোকনাথের প্রথম দর্শন পান তাঁর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই প্রাচীন সন্ন্যাসীদের কথাগুলো-“ আমাদের থেকেও অনেক উন্নত, উচ্চ অবস্থা লাভ করে তোদের জন্য তিনি নিম্নভূমিতে গেছেন ।” ধন্য হন সাক্ষাৎ যোগেশ্বরের দর্শন লাভ করে ।

।।ছাব্বিশ ।।

একবার এক শিক্ষিত যুবক এসেছে বাবার কাছে । সাধু সন্ত বা ধর্মের বিষয়ে বরাবরই সে উদাসীন । কিন্তু মাকে বড় ভালোবাসে সে, সেই মা অসুস্থ । মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতেই তার সাধুর কাছে আসা । বাবার কাছে এসে দাঁড়াতেই বাবা বলে উঠেন- “কিরে, এক ভণ্ড সাধুর সাথে দেখা করতে এসেছিস ।” আশ্চর্য হয়ে যায় যুবক্টি, ঠিক এই কথাগুলোই তো সে নিজের মায়ের কাছে বেশ শ্লেষের সঙ্গে বলেছে বারদীর সাধু বাবার সম্বন্ধে; কিন্তু সে তো তার বাড়িতে, আর সে কথা তো মা ছাড়া কী তৃতীয় ব্যক্তি শোনেনি, তবে সাধু বাবা জানলেন কি করে? কিন্তু ধরা পড়ে যেতে কেমন লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে তার । সাধু বাবার সান্নিধ্যে কি এক দিব্য প্রশান্তি বিরাজ করছে, অন্তর দিয়ে অনুভব করে সে, মুখে কিছুই বলে না, কেমন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ।

বাবার ভাবের পরিবর্তন হয়, কোমল স্নেহভরা কণ্ঠে তিনি-“ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, যে সন্তান মায়ের আদেশ পালন করে, ভগবান তার মঙ্গল করেন । তোর মায়েত্র প্রার্থনা বৃথা যায় না, তুই যে সরকারী চাক্রির জন্য পরীক্ষা দেইয়েছিস তাতে তুই উত্তীর্ণ হয়েছিস । তোর চাক্রির খবর নিয়ে যে চিঠি এসেছে সে চিঠী তোর পকেটেই আছে, খুলে দেখ ।” চিঠি খুলে বাবার সত্যতা প্রত্যক্ষ করে যুবক্টি হতবাক কয়ে যায় । করুণাদ্র কণ্ঠে বাবা তাকে কাছে ডাকেন । এমন স্নেহভরা কণ্ঠের ডাক, এমন অমোঘ আকর্ষণ, মন-প্রাণ তার মুহূর্তের মধ্যে সামনের আসনে উপবিষ্ট

অপিরূপ দিব্যজ্যোতির্ময় মহামানবের চরণ তলে অর্পিত হয়, বাবা পরম স্নেহে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন । অস্থিচর্মসার ঐ দেহের মধ্যে যে এমন পতিতপাবনী প্রেমের গঙ্গার প্রস্রবণ আছে এ যেন মানুষের কল্পনার বাইরে । মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাবা বলেন, “ ওরে তোর বুদ্ধি দিয়ে তুই যতটুকু বুঝেছিস তাই বলেছিস, এতে তোর কোনো দোষ নেই । কতোদিন ধরে কতোভাবেই যে ছায়ার মতো তোর সাথে সাথে থেকে তোকে রক্ষা করে চলেছি তা তোর জানার কথা নয় । তবে যে কথাগুলো ভবিষ্যতের জন্য বলছি শুনে রাখ এবং পারিস যদি চেষ্টা করিস । তোর সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না । কিছুদিকের মধ্যে তোর কর্মজীবন শুরু হবে । তাত্রপর নানান স্থান ঘুরে তুই এই জেলায় কর্তা হয়ে আসবি ।দেখিস, বড় পদ লাভ করে মোহগ্রস্ত হয়ে সত্যকে ভুলে যাস না । দুঃখ এবং দরিদ্রতায় ভরা এই সমাজের দুঃখ দূর করতে সর্বদা চেষ্টা করিস ।আমি তোর সঙ্গে সঙ্গেই থাকবো । যখনই এই কাজে আমার সাহায্য চাইবি তখনই আমার সাহায্য পাবি । “যদি আমার প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতার ভাব অন্তরে অনুভব করিস তো আমাকে ভিক্ষা দিস । দীন দরিদ্র আতুর সহায়সম্বলহীন অনাথের জন্য দয়া করে যা হাতে তুলে দিবি জানবিতা একমাত্র আমিই পাব । আমি ছাড়া যে আর কেউ নেই রে ।”

জয় বাবা লোকনাথ

স্মৃতিঅম্লান

লেখকঅধ্যাপক সুশীল কুমার দাশগুপ্ত যখন প্রিয় প্রতিষ্ঠান ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল গার্লস হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনে ছিলেন ।কর্মজীবনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন । যৌবন কালে সুদর্শন এই পুরুষ পছন্দ করতেন ফুল । ফুলের বাগান করা ছিল লেখকের অন্যতম শখ ।

"Show Menu"